উড়ন্ত:ফিরোজ শাহ কোটলায় ঋদ্ধিমান সাহা-র সেই ক্যাচ।
ক্রিকেটের সবচেয়ে ‘ধন্যবাদহীন’ কাজটা হল উইকেটকিপারের। কারণ, একজন উইকেটকিপার টেস্ট ক্রিকেটে ছ’ঘণ্টা টানা ফিল্ডিং করে যায়। অন্য ফিল্ডাররা কিছুক্ষণের জন্য যদিও বা বল থেকে চোখ সরাতে পারে, উইকেটকিপারকে কিন্তু প্রতিটি বলে চোখ রাখতে হয়। কিন্তু দিনের শেষে একটা স্টাম্প বা ক্যাচ ফস্কালে সেটাই সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
সোমবার ফিরোজ শাহ কোটলায় শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসের ১৩৭ তম ওভারে ইশান্ত শর্মার বলে সাদিরা সমরবিক্রমের যে ক্যাচটা ঋদ্ধিমান ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরল, তা দেখে একটা কথা মনে পড়ছে। কথাটা হল, উইকেটকিপার কখনও তৈরি করা যায় না। একজন ভাল উইকেটকিপার সহজাত প্রতিভা নিয়েই জন্মায়।
যদিও সমরবিক্রমের ক্যাচটাকে আমি ঋদ্ধিমানের ধরা সেরা ক্যাচের মধ্যে দু’নম্বরে রাখছি। এক নম্বরটা অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চলতি বছরের শুরুতে হওয়া টেস্ট সিরিজে। পুণেতে স্টিভ ও’কিফ-এর সেই ক্যাচটা শূন্যে ঝাঁপিয়ে ধরেছিল ঋদ্ধি। বলটা ছিল উপরের দিকে।
আরও পড়ুন: দূষণ কমেনি, বরং বেড়ে থাকতে পারে, দাবি শ্রীলঙ্কার
আর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এ দিনের ক্যাচটা প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো পূজারার বাঁ পায়ের সামনে পড়েছিল। ঋদ্ধিমানের ডান দিকে বলটা কিন্তু মাটি ঘেঁষা ছিল। এক সেকেন্ড এ দিক ও দিক হলেই ক্যাচটা হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারত। নিজে উইকেটকিপার হিসেবে দীর্ঘদিন খেলার সুবাদে জানি, এই ধরনের ক্যাচ নেওয়ার সময় কনুই মাটিতে ধাক্কা খাওয়ায় বল ঝাঁকুনিতে হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঋদ্ধিমান অবলীলায় এই কঠিন ক্যাচটা তালুবন্দি করে নিল। এক্ষেত্রে ওর তিনটি গুণের তারিফ করতেই হয়। তা হল— সময়জ্ঞান, চোখ এবং সঠিক জায়গায় হাতটা নিয়ে যাওয়া। ময়দানের ভাষায় এই ধরনের ক্যাচকে বলে ‘আঙুল চাপা ক্যাচ’।
অ্যাডিলেডে নিজের বলে মইন আলির ক্যাচ ধরছেন নাথান লায়ন।
এই ক্যাচটা ছাড়াও এ দিন মহম্মদ শামির বলে সুরঙ্গা লাকমল এবং অশ্বিনের বলে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের ক্যাচও ধরল ঋদ্ধিমান। কিন্তু এই দু’টো ক্যাচ বেশ ভাল হলেও সেরার তালিকায় পড়বে না। দু’ক্ষেত্রেই বল ‘ক্যারি’ করেছিল। ফলে উইকেটকিপার দেখার সময় পেয়েছে। তবে ম্যাথিউজের ক্যাচটা সহজ ছিল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের কঠিন ক্যাচ ঋদ্ধিমান ইদানীং খুব সহজে ধরছে কী ভাবে?
এর উত্তর একটাই। তা হল, এই ভারতীয় দলে বিরাট কোহালির পরেই ফিটনেসে সেরা ঋদ্ধিমান। অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে ঋদ্ধিমানকে আমি দেখছি। ও যখন ভারতীয় দলে আসেনি, তখনও ফিটনেসের প্রতি যত্নশীল ছিল সর্বদা। তার সুফল ও এখন পাচ্ছে।
একজন ভাল উইকেটকিপার হতে গেলে দরকার তিনটে গুণের। এক, অনুমানক্ষমতা। দুই, রিফ্লেক্স। তিন, ফিটনেস। এর মধ্যে প্রথমটা সহজাত। আর ফিটনেস ঋদ্ধিমান অর্জন করেছে ওর পরিশ্রম দিয়ে। যে কারণে ঋদ্ধির বল ধরার ভঙ্গিটাও বেশ চমৎকার। যা দেখলে আমার ইংল্যান্ডের প্রাক্তন উইকেটকিপার বব টেলরের কথা মনে পড়ে। বব যখন বল ধরত তখন কোনও শব্দ হতো না। ঋদ্ধির বল ধরাও সে রকম। একেবারে নিঃশব্দে।
মনে রাখবেন পিচে বল ঘুরলে কিন্তু উইকেটকিপারের কাজটা অনেক সহজ। কোটলায় কিন্তু অসমান বাউন্স রয়েছে পিচে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঋদ্ধিকে বল ধরতে দেখে একবারও মনে হচ্ছে না ওর কষ্ট হচ্ছে। ঋদ্ধিকে এক বার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভারতীয় দলে কোন বোলারদের ‘কিপ’ করা কঠিন? ঋদ্ধি বলেছিল অশ্বিন আর ইশান্ত শর্মার কথা। কিন্তু তাদের বলেই এখন দুর্দান্ত ক্যাচ ধরছে।
• শ্রীলঙ্কার ইনিংসের ১৩৭তম ওভার। ইশান্ত শর্মার আউটসুইঙ্গার সাদিরা সমরবিক্রমের ব্যাটের কানায় লেগে প্রথম স্লিপের দিকে যাচ্ছিল। পাখির মতো উড়ে গিয়ে ক্যাচ ধরেন ঋদ্ধিমান। প্রথম স্লিপের সামনে থেকে নিচু ক্যাচটি তিনি তুলে নেন ছোঁ মেরে।
• সব মিলিয়ে চারটি ক্যাচ নিয়েছেন ঋদ্ধি। অশ্বিনের বলে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের ক্যাচটিও নেন দুর্দান্ত রিফ্লেক্সে। ক্যারম বল বুঝতে পারেননি সেঞ্চুরি করা ম্যাথিউজ। ব্যাটের কানায় লেগে বেশ জোরেই এসেছিল। অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় তা উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে ‘কিপ’ করা ঋদ্ধি লুফে নেন।
• গত ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে স্টিভ ও’কিফের ক্যাচ ধরেছিলেন উড়ে গিয়ে। যা দেখার পরে ক্রিকেট দুনিয়া নামকরণ করেছিল ‘ফ্লাইং সাহা’।
ছবি: রয়টার্স ও টুইটার