অরণ্যের সেই প্রাচীন প্রবাদের মতোই প্রতিপক্ষ তাঁর সম্পর্কে ফিসফিসিয়ে বলতে পারে, “আর যাকে রাগাও ওকে রাগিও না। তা হলেই সর্বনাশ!”
কে তিনি? তিনি বিরাট কোহলি। সচিন পরবর্তী টিম ইন্ডিয়ার জবরদস্ত মুখ ও মনন। সত্তর দশকের অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের মতোই যাঁর মনের ভিতরে গনগনে রাগ। যা সুনামির মতো আছড়ে পড়ে বাইশ গজে। কেন এত রেগে যান বিরাট? এটা কি গেমসম্যানশিপ নাকি রাগটা তাঁর মজ্জাগত?
প্রশ্ন শুনে দিল্লির বাড়ি থেকে বিরাটেরই ক্রিকেট পাঠশালার প্রথম কোচ রাজকুমার শর্মা বললেন, “এই আগ্রাসী মনোভাবটা বিরাটের মজ্জাগতই। ছোট থেকেই দেখতাম চ্যালেঞ্জ নিতে ছেলেটা ডরপোক নয়।” একটু থামার পর পরক্ষণেই ফের বলতে শুরু করলেন, “তবে এই রাগ, আক্রমণাত্মক মনোভাবটা কিন্তু বিরাটের মস্তিষ্কে নিখুঁত ভাবে নিয়ন্ত্রিত। সেটা কাজে লাগিয়েই বিরাট হারিয়ে দেয় বাকিদের।”
রাজকুমারের কথার সমর্থন মিলছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রিমা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “বাইরে থেকে দেখে মনে না হলেও বিরাট কোহলির মেজাজটা কিন্তু নিয়ন্ত্রিত। আর সেটা দিয়েই ফায়দা তোলে ও। স্লেজিং বা বিপক্ষের বডি ল্যাঙ্গোয়েজের সামনে বিরাটের আসল মূর্তি বেরিয়ে আসে রেগে গেলেই। সেটাই ওর বাড়তি মোটিভেশন।”
সেটা কেমন? এ বার বলতে শুরু করলেন রাজকুমার। “২০০৮-এ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারত গুটিয়ে গেল ১৫৯ রানে। লাঞ্চে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এসে ওকে বলে, ‘এত কম রানে গুটিয়ে গেলে! কাপটা জোহানেসবার্গেই যাচ্ছে তা হলে।’ বিরাট ওকে সে দিন পাল্টা বলে১১০-এর ওপরে তোমরাও যাবে না। তাই কাপটাও যাবে ইন্ডিয়াতে। মাঠেও ঠিক সেটাই হয়।”
রিমা মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, “বিরাটের মনের গভীরে ঢুকতে পারলে দেখা যাবে কেউ ওকে দাবিয়ে রাখছে সেটা ও হতে দেবেই না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সব সময় ইতিবাচক। মনোভাবটা এ রকম, তুমি যেই হও না বাছা, আমি তোমায় ভয় করি না।” একটু থেমে তার পর আরও বললেন, “মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায়, এই ধরনের ব্যক্তিত্বরা ইতিবাচক আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে বাঁচেন। তার ফলে রাগলে ওঁরা ভিতরে ভিতরে আরও উসকে যান।”
কেন এমন হয়? রিমার ব্যাখ্যাএই ধরনের ব্যক্তিত্বরা কিন্তু সর্বদা হোমওয়ার্ক করে নিজেদের তৈরি রাখেন প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য। কোহলির ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। তাই বলতে পারছেন, “এখানে ক্রিকেট খেলতে এসেছি। কারও গালাগাল শুনতে নয়।”
বিরাটের পাল্টা দেওয়ার এই মনোভাব সম্পর্কে রিমাদেবীর বিশ্লেষণ, “মানসিক ভাবে বিরাট একজন টাফ পার্সোন্যালিটি। জানে, এই দুনিয়ায় বাঁচতে গেলে লড়তে হবে। ফ্রি লাঞ্চ বলে কিছু হয় না। তাই জনসনদের ক্রমাগত স্লেজিংয়ের সামনে ফ্লাইটের (পালানো) বদলে ফাইটকেই বেছে নিয়েছে ও।”
রাজকুমারের বক্তব্যও প্রায় সে রকম: যখন ওদের ছোট বেলায় বলতাম ১৪৫ বা ১৫০ কিমি বেগে বল আসতে দেখলে কী করবে? অন্যরা চুপ করে ভাবত। আর বিরাট সময় না নিয়েই বলত কেন পাল্টা মারলেই তো বলের গতি কমে যাবে। বয়স যখন মাত্র তেরো তখনই নেটে ১৯-২০ বছর বয়সি বোলারদের (যাদের অনেকেই তখন রঞ্জি খেলে ফেলেছে) পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বলত, “ধুর, আমাকে তুমি আউট করতেই পারবে না। দাও দেখি বাউন্সার। দেখি তোমার দম। বিরাটটা এ রকমই।”
আর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা? সেটাও বেশ চমকপ্রদ। যা দিচ্ছেন রিমা মুখোপাধ্যায় রাগলে যখন অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হয়, তখন বিরাটের মতো মানুষরা আরও চনমনে হয়ে পড়ে। বেড়ে যায় এনার্জি লেভেল, মনঃসংযোগও। তখন ছোটখাটো ভুলও করে না এই সব ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু রাগী যুবক বিরাটের এই রাগের রেশ যদি ড্রেসিংরুমে পড়ে তখন? ফলটা কি খারাপ হতে পারে, না ভাল?
রিমাদেবী বলছেন, “ভালই হবে। ওকে দেখে টিমের অন্যরাও অনুপ্রাণিত হবে এই ভেবে যে ও যখন পারছে, আমরাও পারব। আর টিম গেমে ড্রেসিংরুমে এই পজিটিভ এনার্জিটাই বদলে দিতে পারে অনেক কিছু।”
রাজকুমারও বলছেন প্রায় একই কথা, “গত বার দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার আগে মর্নি মর্কেলকে নিয়ে ভারতীয়দের চিন্তার শেষ ছিল না। কিন্তু প্রথম টেস্টে ওকে অবলীলায় খেলে বিরাট সেঞ্চুরিটা করার পরেই কিন্তু মর্কেল ভীতি কেটে গিয়েছিল টিম ইন্ডিয়ার। এ বারও মিচেল জনসনকে খেলতে কিন্তু ভয় পাচ্ছে না রাহানে-ধবনরা।”