স্বপ্ন ছোঁয়ার পর। চূড়ান্ত চাপের মুখে জয়সূচক বাউন্ডারিটা এল চাওলার ব্যাট থেকে। তাঁকে আদর টুর্নামেন্টে সব চেয়ে বেশি রান করা উথাপ্পার। রবিবার চিন্নাস্বামীতে। ছবি: পিটিআই।
কিংস ইলেভেন পঞ্জাব: ১৯৯-৪ (২০ ওভার)
কলকাতা নাইট রাইডার্স: ২০০-৭ (১৯.৩ ওভার)
বাঁ হাতের তর্জনীটা উঠে সোজাসুজি আকাশের দিকে, মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত সজোরে আঘাত করে যাচ্ছে বুকে। এক, দুই তিন... একের পর এক! ডাগআউটের কাছ থেকে কেউ একটা ডাকলেন বাদশাকে। প্রেসবক্সের ঠিক বাঁ দিকে ভিআইপি গ্যালারি থেকে উত্তরে তিনি যে ইঙ্গিতটা করলেন, মানে একটাই হয় কী, লাফিয়ে নামতে বলছ নাকি?
রাত সওয়া বারোটা। মাঝরাতের চিন্নাস্বামীকে ‘ছইঁয়া, ছঁইয়া’ কে বাজাচ্ছে এমন চূড়ান্ত ডেসিবেলে? আর যিনি উন্মত্তের মতো নাচছেন, কে উনি? ওহ্, শাহরুখই তো। পাশে কে? মালাইকা অরোরা? একশোয় গোল্লা পেলেন। উনি মণীশ পাণ্ডে! ইতিহাস গড়লে শুধু চলবে কেন, ছঁইয়া ছঁইয়াটাও তো শিখতে হবে। এবং কী আশ্চর্য, মণীশের একটা স্টেপেও ভুল হল না। মিচেল জনসনদের ধ্বংসে যেমন সাবলীল, নাচেও। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে টিভি ক্যামেরা ধরল শাহরুখকে, এ বার সঙ্গে সঙ্গে আর এক সুপারহিট গান ‘জানম দেখ লো...ম্যাঁয় ইঁয়া হুঁ..ইহা হুঁ ইহা..।’
দেখলেন বটে প্রীতি জিন্টা! চোখের সামনে নিজের প্রথম সিনেমার মহানায়ককে ছঁইয়া ছঁইয়া নেচে যেতে দেখলেন, দেখলেন চরম টেনশনের প্রেক্ষাপট থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে আসা আবেগের সংজ্ঞা কী হতে পারে। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখা গেল, আজ পর্যন্ত যে ক’টা সিনেমাতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন শাহরুখ-প্রীতি, অধিকাংশতেই নাকি স্পটলাইটের যুদ্ধে ‘জারা’ ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দিয়েছেন ‘বীর’কে। সে সব আজ কোথায়? জারা তো আজ কিং খানের সামনে পরাভূত থেকে গেলেন। গালে টোল ফেলা ভুবনভোলানো হাসি-প্রদর্শনের বদলে রবিবার পুরোদমে শাহরুখ শো।
আজ হবে না তো কবে হবে? দু’বছর পর আবার তো ইতিহাস! আবার তো আইপিএল কলকাতার। আবার তো ইডেনে আসছেন শাহরুখ। গোটা কলকাতাকে ‘ছঁইয়া ছঁইয়া’ নাচাতে! এক সিএবি কর্তা জানালেন, আগামিকাল সন্ধেতেই টিম পৌঁছচ্ছে কলকাতায়। পরশু ইডেনে সংবর্ধনা। চেষ্টা চলছে, দু’বছর আগের মতো মঙ্গলবারও যেন আইপিএল জয়োৎসবে পাওয়া যায় শাহরুখের ‘দিদি’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
“মমতাদি-র কাছে প্রমিস করেছিলাম, জিতলে আবার কলকাতায় আসব। প্রমিস রাখছি, আসছি” টিভি সঞ্চালককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন শাহরুখ। আজ জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কেকেআর-কে। চিন্নাস্বামীতে হাজির তাঁর দুই প্রতিনিধি ফিরহাদ হাকিম এবং অরূপ বিশ্বাস সেই শুভেচ্ছাবার্তা পৌঁছে দেন শাহরুখকে। এবং মুখ্যমন্ত্রীর শুভেচ্ছা রইল আর এক বঙ্গসন্তানের জন্যও। যিনি ছিলেন বিপক্ষে। কেকেআরের এমন ঐতিহাসিক জয়েও ঢাকা পড়ছে না যাঁর কীর্তি।
ভিভিআইপি বক্সে গাওস্কর, বিশ্বনাথদের আলোচনা চলছিল ‘উয়ো, সাহা হ্যায় ইয়া শাহ্, হোয়াট আ নক!’ ঋদ্ধিমান সাহা আইপিএল ফাইনালের এখনও পর্যন্ত একমাত্র সেঞ্চুরিকারী! কোনও আইপিএল ফাইনালে ৫৫ বলে ১১৫ নট আউট গত সাতটা বছরেও কেউ করে যেতে পারেননি। নারিন-মর্কেল চূর্ণ হলেন বাঙালির নির্মম আগ্রাসনের কাছে।
একটা সময়ে সত্যিই মনে হচ্ছিল, বাংলার জয়ের পথে বোধ হয় কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে গেলেন এক বাঙালিই। তখন কে জানত, প্রথম ওভারে রবিন উথাপ্পার প্রস্থানের পরেও আবির্ভাব ঘটবে মণীশ পাণ্ডে নাম এক দক্ষ কান্ডারির? চিন্নাস্বামী প্রেসবক্সে সঙ্গে তুলনা টানা চলছে দু’টো মোহিনী রাতের। দু’বছর আগের চিপক নাকি আজকের চিন্নাস্বামী কোনটা বেশি আকর্ষণীয়? কেকেআরের ক্যাবিনেটে কোনটাকে আগে রাখা উচিত?
সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ দু’টো রাতের মধ্যে আশ্চর্য মিল। চিপকে কোনও এক মনোজ তিওয়ারি লাস্ট ওভার ফিনিশ করে টিমকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। রবিবার পীযূষ চাওলা আবির্ভূত হলেন চিপকের ‘মনোজ’ হয়ে! এবং ফের সেই লাস্ট ওভার ফিনিশ। আর শুধু বাইশ গজের যুদ্ধে নয়, বাইশ গজের বাইরেও যে সমান টেনশনের আবহ সৃষ্টি হল, তা টিভি দেখে বা পড়ে কারও পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। চিন্নাস্বামীতে তার জন্য থাকতে হতো।
প্রেসবক্সের বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়েছেন শাহরুখ। ২৪ বলে আর ৩৯ চাই, তা হলেই টপকে যাওয়া যাবে পঞ্জাবের ছুড়ে দেওয়া দু’শো রানের সমুদ্রসম টার্গেট। মণীশ বিশাল একটা ছক্কায় মাঠের বাইরে ফেলে দিলেন পঞ্জাবের লেগ স্পিনারকে। ‘কাম অন...’ বলে চিৎকার কিং খান করলেন কি করলেন না, পরের বলেই রায়ান টেন আউট!
পাঁচ মিনিট পর ১৮ বলে ২১ চাই, মণীশ ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন সেঞ্চুরির দিকে। আরসিবি-র হোম গ্রাউন্ডকে যখন আরও...আরও গর্জনের নির্দেশ দিচ্ছেন শাহরুখ, ঠিক পরের বলেই কভারে বেইলির হাতে বন্দি মণীশ! পনিটেলে অসহায় ভাবে হাত চালাতে চালাতে পাশে দাঁড়ানো কন্যাকে কী যেন একটা বললেন বাদশা।
৭ বলে ১১... ৪ বলে ৪... চিন্নাস্বামীর জায়ান্ট স্ক্রিন দু’ভাগ করে অবিশ্বাস্য ফ্রেম। একটায় শাহরুখ। একটা প্রীতি। অসহ্য টেনশনে আক্রান্ত দু’জনে। পরবিন্দর আওয়ানার বল পীযূষ থার্ডম্যান ও পয়েন্টের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠালেন আর...।
আর, গোটা মাঠ জুড়ে পীযূষের দৌড়। টিম মালিককে কোলে তুলে নিয়ে নিজের অরেঞ্জ ক্যাপ সযত্নে উথাপ্পার পরিয়ে দেওয়া। গ্যালারির দিকে ছুটে গিয়ে কিং খানের সমারসল্ট। টি-শার্ট টেনে তুলে সিক্স প্যাকস দেখিয়ে কখনও ভাংড়া, কখনও লুঙ্গি ডান্স। তখন...
ভাইচুং ভুটিয়া হাসছেন। অরূপ বিশ্বাসরা উৎসব করছেন। রবিবার রাতের বেঙ্গালুরু দর্শক নাচছে, গাইছে, কেকেআরের জার্সি ওড়াচ্ছে শাহরুখের তালে তালে।
আতসবাজির রোশনাই তখন রাতের কালোকে মুছে নতুন নতুন রং সৃষ্টি করছে। স্বপ্নপূরণের রং। লাল, নীল, বেগুনি, সোনালি!
‘পার্পল ইজ ফর প্রাইড, গোল্ড ইজ ফর ভিকট্রি!