ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
সত্যিই সেই মাহাত্ম্যের ফাইনাল যার সম্পর্কে একদা বলা হত, কেউ জেতেনি।
কেউ হারেনি।
জিতেছে শুধু ক্রিকেট!
শাহরুখ খান অবশ্য বরাবর উল্টো জীবনধারাতেই বিশ্বাস করে এসেছেন। কেকেআরে তাঁর প্রাক্তন কোচ জন বুকানন যা বলতেন, এসআরকেরও একই মত। রুপো তুমি কখনও জিততে পারো না। তুমি সোনাটাই শুধু হারাতে পারো।
কেকেআর অবশ্য রোববার মাঝরাতের চিন্নাস্বামীতে নিছক সোনাই জেতেনি। একটা টেমপ্লেটও তৈরি করে দিয়ে গিয়েছে। টিম স্পোর্টে এমনই গুরুত্বপূর্ণ টেমপ্লেট যা ভবিষ্যতে যখনই কোনও টিম ধারাবাহিক ভাবে বিপদে পড়বে, দুর্যোগে চুল ছিঁড়তে বাকি রাখবে, তখনই সে অবধারিত কেকেআরের মন্ত্রের খোঁজ করবে। বিশ্বক্রিকেটে সেরা সময়ের পাকিস্তান বা অস্ট্রেলিয়ার মানসিকতার সঙ্গে অন্তত তুলনীয় হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে গম্ভীরের কেকেআর।
সাধারণ ভাবে ফুটবলের তুলনায় ক্রিকেট মোটেও টিম স্পোর্ট নয়। ক্রিকেট ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের খেলা। একজন তেন্ডুলকর, একজন সোবার্স, একজন ব্র্যাডম্যান সেখানে টিমের ছ’সাত জনের ব্যর্থতা ঢেকে জিতিয়েও দিতে পারেন। অথচ টি-টোয়েন্টি চরিত্রগত ভাবে সাবেকি ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে। ড্রেসিংরুম ধর্মেও বরং ফুটবলের বেশি কাছাকাছি। টেস্ট তো ছেড়েই দিচ্ছি। ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জেতার জন্যও যে ড্রেসিংরুমে দুর্ধর্ষ টিম স্পিরিটের প্রয়োজন হয় না, ভারতই দু’বার প্রমাণ করেছে।
টি-টোয়েন্টিতে যা সম্ভব নয়। আইপিএলে তো নয়ই। দিন চব্বিশ আগে কোটলায় একটা স্বপ্নের উড়ান শুরু করে কেকেআর। আর তার দুর্ধর্ষ অবতরণ ঘটল রোববার চিন্নাস্বামীতে। একটা সময় যে টিমটা কুখ্যাত ছিল চাপের ম্যাচ হারার জন্য। অভিশপ্ত থাকত তার আইপিএল সফর। এখন তারাই কিনা প্রসিদ্ধ হয়ে গেল রুদ্ধশ্বাস চাপে পড়া সেই ম্যাচগুলো বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সৌরভ যে টিম ধরেছিলেন আর গম্ভীর যা তৈরি করেছেন। বুকানন যে দলের কোচ ছিলেন আর বেলিস এখন যার। তার অন্তর্জগতে যেন একটা রূপান্তরের পেটেন্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে। গোটা ক্রিকেট পৃথিবী চাইবে যে পেটেন্টের সন্ধান। টানা ন’ম্যাচ জিতে এমন চ্যাম্পিয়ন হওয়া আইপিএল ইতিহাসেই কখনও নেই। রোববার চিন্নাস্বামীতে শুধু তা ঘটেইনি। রেখে গিয়েছে কিছু টোটকা, যা ভাবীকাল অনুসরণ করবে।
যেমন এক, টিমের মধ্যে একগুচ্ছ সুপারস্টারের দরকার নেই। প্রত্যেকটা পজিশনে রাখতে হবে প্রয়োজনীয় প্লেয়ার। তাদের তারার আলো মিটমিটে হলেও চলবে। কিন্তু চাপের মুখে প্রয়োজনে আসার দক্ষতা চাই।
দুই, ড্রেসিংরুম অবশ্যই শান্ত রাখতে হবে।
তিন, দলের স্বার্থ অনুযায়ী মহাতারকাকে বাদ দিতে বাধ্য হলেই শুধু হবে না। মহাতারকাকে প্রত্যুত্তরে জাক কালিসের মতো মহানুভব হতে হবে। বলতে হবে আমি খেলছি না তো কী, আমি তো ওদের পাশে থেকে খেলায় সাহায্য করতে পারি।
চার, বোলিংয়ে যথেষ্ট বৈচিত্র আর ভারসাম্য দুটোই থাকা চাই। টি-টোয়েন্টি শুধু ব্যাটিংয়ে জেতা যায় না।
পাঁচ, চাই টিমের মধ্যে সুসংহত বিভাগ।
বিশ্বকাপের আগে জার্মান কোচ জোয়াকিম লো যেমন বলছেন, আমার কোনও মেসি নেই। কোনও রোনাল্ডো নেই। কিন্তু আমাদের সব পজিশনে দারুণ সব প্লেয়ার আছে। এ বারের কেকেআরের মন্ত্রও তাই।
চাপের মুখে আইপিএল ফাইনালে সর্বকালের কঠিনতম ম্যাচটা তারা বের করল। স্রেফ টি-টোয়েন্টির এ সব আধুনিক স্মার্ট মতবাদকে ভিত করে। না ছিল তাদের কোনও যুবরাজ, না ধোনি, না কোহলি। অথচ ছিল প্রত্যেকটা জায়গায় বাড়তি স্মার্ট ক্রিকেটার তৈরি ছিল। অতীতের কেকেআর ঠিক উল্টো। সেখানে একটা সৌরভ। একটা শোয়েব। একটা পন্টিং। একটা ব্রেট লি। কিন্তু তাতে না তৈরি হয়েছে ড্রেসিংরুম ঐক্য। না হয়েছে দলগত সংহতি। একই কম্বিনেশন টেস্ট ক্রিকেটে সোনা ফলিয়ে দিতে পারত। কারণ টেস্ট বা ওয়ান ডে পর্যায়ে ব্যক্তিগত প্রাধান্যের জমিটা অনেক শক্ত। কিন্তু এখানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির ঠিকঠাক মিলমিশ হয়ে একটা কম্বিনেশন ব্যতীত সাফল্য আসতেই পারে না। আইপিএল চ্যাম্পিয়ন একক জ্যামিতিতে হওয়া সম্ভব নয়।
প্রথম তিন বছর তাই মহাতারকা নির্ভর কেকেআর ছিল আইপিএলের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস অথচ হাস্যকর মুখ। শেষ তিন বছরের কেকেআর নন-গ্ল্যামারাস অথচ সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ।
আন্ডারডগদের সেরা প্রহর অবশ্যই ছিল রোববারের চিন্নাস্বামী। প্রথমে ঋদ্ধিমান সাহা। পরে মণীশ পাণ্ডে। সবশেষে পীযূষ চাওলা। এই চাওলাকেই নিলামে কেন কেনা হয়েছিল, তা নিয়ে কেকেআর টিম ম্যানেজমেন্ট জাতীয় মিডিয়ার তীব্র গালমন্দের সামনে পড়েছিল। প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও হেসেছিলেন। এখন হাসছেন কেকেআর টেবলে নিলাম-নীতি। এই পীযূষের ৫ বলে অপরাজিত ১৩ না হলে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অসাধারণ উচ্ছল প্রীতি জিন্টাকে পাওয়া যেত। আসলে কেকেআর টেমপ্লেট করে দিয়ে গেল, ট্রফি জেতায় আন্ডারডগ আর তারকার ব্যালান্সড কম্বিনেশন। সেটা শুধু তারকাদের কম্মো নয়।
নিলামের পর লিখেছিলাম, এই অদ্ভুত কম্বিনেশনের কেকেআর আইপিএল জিতলে ঢাকুরিয়া লেক থেকে গলদা চিংড়িও উঠতে পারে। সোমবার দুপুরে ভাবছি লেকের কাছটা এক বার ঘুরে আসব!