তাঁকে পাওয়া গেল সাও পাওলোর বাড়িতে। তিনি এ বার নিয়ে সপ্তম বিশ্বকাপে ফিফার পর্যবেক্ষক। নানা ম্যাচ দেখে বেড়াচ্ছেন। ফোর্তালেজা যাননি। তবে ব্রাসিলিয়া যেতে পারেন আর্জেন্তিনাকে দেখতে। সাও পাওলো মাঠে আগের সপ্তাহে অবশ্য মেসিকে দেখে এসেছেন। আর ফাইনালে তো মারাকানা যাবেন-ই। তিনি মার্কোস ফালোপা, প্রাক্তন ইস্টবেঙ্গল কোচ শুক্রবার সকালে ফোনে অনেক কথাই বললেন...
প্রশ্ন: কী হবে আজ?
ফালোপা: আমার মন বলছে ব্রাজিল জিতবে। কলম্বিয়া অনেক ওপেন অ্যাটাকে খেলে। ওরা যত ওপেন খেলবে তত ব্রাজিলের সুবিধে।
প্র: গত সপ্তাহে এবিপিকে ব্র্যাঙ্কো ঠিক একই কথা বলেছেন।
ফালোপা: তাই! আমি ব্র্যাঙ্কোর সঙ্গে একমত।
প্র: কিন্তু বাকি পৃথিবী বোধহয় এক মত হচ্ছে না। বরং বলছে, ওই ওপেন অ্যাটাকগুলো থেকেই তো গোল করে দেবে কলম্বিয়া!
ফালোপা: এত সহজ হবে না। কাল ফোর্তালেজায় ব্রাজিলের ট্রেনিং দেখাচ্ছিল টিভিতে। আমার তো দেখে দারুণ লাগল।
প্র: হামেস রদ্রিগেজকে থামাবে কে? ব্রাজিলের তো গুস্তাভো থাকছে না।
ফালোপা: তাতে কী! পওলিনহো আছে। ফার্নান্দিনহো আছে। তা ছাড়া এখন ম্যান মার্কিংয়ের দিন গিয়েছে। রোনাল্ডোকেও দেখলেন না সবাই জোনাল মার্ক করছিল।
প্র: আপনার কি মনে হচ্ছে না স্কোলারির টিম কম্বিনেশনে কোথাও গণ্ডগোল হচ্ছে?
ফালোপা: ফিলিপাও খুব বড় কোচ। ভাল মানুষও। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে দিনও ওঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি সিওর কলম্বিয়া ম্যাচে উনি স্ট্র্যাটেজি বদলাবেন।
কিন্তু আমার মনে হয়, যেটা আসল ভুল হয়ে গিয়েছে এবং এখন শুধরোনো সম্ভব নয় সেটা হল, এই টিমটা বিশ্বকাপের পক্ষে একটু অনভিজ্ঞ হয়ে গিয়েছে। রবিনহোকে দলে রাখা উচিত ছিল।
প্র: এত যে খেলা দেখলেন কাদের খেলা ভাল লাগল?
ফালোপা: নেদারল্যান্ডস আর জার্মানি।
প্র: কেন?
ফালোপা: খেলার ট্যাকটিকাল দিকগুলো খুব ভাল ওদের। পাসিংয়ে একটা কমপ্যাক্ট ব্যাপার আছে।
প্র: আর?
ফালোপা: আমাকে চমকে দিয়েছে কোস্টারিকা। ফুটবল উন্নতির জন্য অনেকগুলো বছর ওখানে কাটিয়েছি বলে জানি, কী ভাবে ধাপে ধাপে ওরা উঠেছে! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে সেমিফাইনালে কোস্টারিকা খেলবে আর্জেন্তিনার সঙ্গে।
প্র: ফ্রান্স-জার্মানি?
ফালোপা: জার্মানি বড় ম্যাচে দুর্ধর্ষ। কিন্তু ফ্রান্সের অ্যাটাকিং প্লে-র যা শান দেখছি ওরা জিতবে মনে হচ্ছে।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, না ফ্রান্স পারবে না। সেমিফাইনাল লাইন আপ হবে ব্রাজিল-জার্মানি ওদিকে আর্জেন্তিনা-কোস্টারিকা। আমি এতগুলো বিশ্বকাপ দেখেছি। আমার মতে ব্রাজিল ওয়ার্ল্ড কাপ ইজ দ্য বেস্ট।
প্র: এর মধ্যে যে সুয়ারেজ বিতর্কটা হল সেটা নিয়ে কী বলবেন? আপনি তো অনেক বছর ফিফার সঙ্গে জড়িত।
ফালোপা: একেবারে ঠিক শাস্তি দিয়েছে। মনে হচ্ছে একটু বেশি কড়া। কিন্তু তার কারণ আছে। লোকটা এর আগে দু’বার একই কাজ করেছে। যদি প্রথম বার দাঁত বসানোটা ঘটত, এত কড়া শাস্তি দিত না।
প্র: মেসির খেলা দেখে কী মনে হল? কোচ হিসেবে কী ভাবে ওর ব্যাখ্যা হয়?
ফালোপা: কোচ ওর জন্য সবিস্তার পরিকল্পনা করতে পারে। করেও। কিন্তু মেসি এমন একজন জিনিয়াস যে কয়েক সেকেন্ডে সব বদলে দিতে পারে। ওর দরকার মাত্র কয়েক সেকেন্ড!
প্র: আপনি একটু আগেই বললেন, বেস্ট বিশ্বকাপ। কীসের ভিত্তিতে বললেন?
ফালোপা: এই যে ছোট-বড় কার্যত ঘুচে গিয়েছে এ রকম লড়াই তো আর কোনও বিশ্বকাপে হয়নি। ফিফার লোক হিসেবে এত দেশে আমি ঘুরেছি। কোচিং করিয়েছি। আজ সত্যি খুব তৃপ্তির দিন যখন দেখছি, আমার মতো দেশ-বিদেশ ঘুরে কোচিং করা লোকেরা কিছু করে দেখাতে পেরেছে।
প্র: আপনার মতে ছোট টিমগুলো এই যে বড়, নামকরা দেশগুলোকে এত বেগ দিচ্ছে তার কারণ কী?
ফালোপা: কারণ, একই রকম উন্নতির সুযোগ পাওয়া। তারা এত দিন একই মানের কোচ পেত না। ফিজিও পেত না। জানত না কী করে বিশ্ব পর্যায়ে মহড়া নিতে হয়! এখন সবাই কমবেশি তৈরি। সবাই জানে কী করতে হবে। এই যে পাঁচ-ছ’টা দেশ ফুটবলে দাদাগিরি করে যেত সেই দিন শেষ হয়ে গেল। আমি ব্রাজিলের লোক হয়ে বলছি।
প্র: কিন্তু কোথায়, এশীয় দেশগুলো তো কিছুই পারেনি! তারাও তো নামী কোচ, নামী ট্রেনার, সেরা ফিজিও সবই পেয়েছে।
ফালোপা: কিছুটা ঠিক। জাপান নিয়ে আমি খুব আশাহত। অনেক কিছু আশা করেছিলাম। কোরিয়াও পারল না। তবে ইরান দুর্ধর্ষ লড়েছে। দিয়েছিল তো প্রায় মেসিকে আটকে!
প্র: আপনি কলকাতায় কোচিং করিয়েছেন। মনে করুন, যে ক্লাবে কোচিং করাতেন সেই ইস্টবেঙ্গলের ‘রিও’ পৌঁছতে ক’বছর আনুমানিক লাগবে? দশ? পনেরো? নাকি সম্ভাবনাই নেই?
ফালোপা: ইস্টবেঙ্গল রিও এসে কী করবে!
প্র: ইস্টবেঙ্গল তো ভারতের একটা টপ টিম। তারা আনুমানিক কবে মারাকানায় নামার যোগ্য হবে বলে মনে হয়?
ফালোপা: না, এখানকার থার্ড ডিভিশন টিমের সঙ্গে খেলতে হলেও ওদের অনেক বছর ধরে তৈরি হতে হবে। মারাকানায় এখন নামার কোনও ব্যাপার দেখছি না।
প্র: কিন্তু আপনিই তো একটু আগে বললেন, ছোট দেশগুলোর অগ্রগতি দেখে আপনি মুগ্ধ। তো তারা যদি উন্নতি করতে পারে, ভারত পারবে না কেন?
ফালোপা: কারণ কলকাতার ক্লাবগুলোর ইয়ুথ ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে কোনও ভাবনাই নেই। আমি একটা জিনিস সার বুঝে গিয়েছি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে প্রস্তুতি। এ বারের বিশ্বকাপ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
আমি কাতারে কাজ করেছি ১৯৭৯-’৮৩। যা বলেছি কাতার কর্তারা তাই শুনেছেন। ওঁরা সত্যি সত্যি দেশের ফুটবলকে এগোতে চেয়েছিলেন। সৌদিও তাই। একটা পরিকল্পনা নিয়ে আঁকড়ে পড়ে থেকেছে। জাপানও তাই। ইরান তাই।
প্র: সেটা তো করবে জাতীয় ফেডারেশন। ক্লাব করবে কেন?
ফালোপা: কারণ ভারতের স্ট্রাকচারে ক্লাবই সব। ক্লাবকেই যুব উন্নতির ব্লু-প্রিন্ট বার করতে হবে। ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের আমি বলারও চেষ্টা করেছিলাম, ওই জায়গাটা কী যেন...কল...কল...
প্র: কল্যাণী?
ফালোপা: হ্যাঁ, হ্যাঁ কল্যাণী। আমি ওখানকার অ্যাকাডেমি থেকে দু’টো ইয়ুথ প্লেয়ার স্পট করেছিলাম। ক্লাবকেও বলেছিলাম। নীতু আর ওই ভাইস প্রেসিডেন্ট কল্যাণ মজুমদারকে...।
প্র: ভাইস প্রেসিডেন্ট না, কল্যাণ ক্লাবের সেক্রেটারি।
ফালোপা: ওই হল আর কী! তো এরা ভাল লোক। আমার সঙ্গে এখনও খুব ভাল সম্পর্ক। কিন্তু ওদের দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরোটাই ট্রফি জেতা ভিত্তিক। ইয়ুথ প্লেয়ার খেলানোর ঝুঁকি নেবে না, বাইরে থেকে বিদেশি নিয়ে আসবে। আমাকে বলুন, তা হলে কী করে দেশের উন্নতিটা হবে?
ক্লাবকে নিজের ইয়ুথ টিমটা বরং এত স্ট্রং করতে হবে যে সেটাই সিনিয়র টিমের সাপ্লাই লাইন হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কলকাতায় তো সেটা হয় না। কোচকে ওরা ক্ষমতাও দেয় না। আমি যখন ইয়ুথ, ইয়ুথ করে মাথা খুঁড়ছি, ওরা বলল পুরো জোর দিতে হবে চিডি আর সুয়োকাতে। আমি বললাম, সুয়োকা চলবে না। ওরা জোর দিল, না চলবে।
এ ভাবে চললে কি মারাকানায় নামা যায়? ওই সুয়োকাটা কি এখনও ইস্টবেঙ্গলে খেলে?
প্র: সুয়োকা ছেড়ে দিন। আমাকে বলুন, ঠিক ভাবে প্রস্তুত হলে মারাকানায় পৌঁছতে ক’বছর? আদৌ সম্ভব?
ফালোপা: সম্ভব। অনেক সময় লাগবে...পাঁচ তো বটেই।
প্র: পাঁচ না দশ? আপনার মনের কথাটা বলুন।
ফালোপা: একেবারে ঠিক ভাবে প্রস্তুতি নিলে সাত-আট বছরে অন্তত মারাকানায় নামা যাবে। সে না হয় ব্রাজিলের ফার্স্ট ডিভিশন না-ই বা হল। রিও এসে না হয় আমাদের থার্ড ডিভিশন টিমের সঙ্গেই খেলল।
তবে আগে তো দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে রাজি হোক। তার পর রিও। তার পর মারাকানা।