গোলের শট। যুবভারতীতে কাতসুমি। রবিবার। ছবি: উত্পল সরকার
মোহনবাগান-৩ (কাতসুমি-২,সনি)
মুম্বই এফসি-১ (জোসিমার)
রবিবার দুপুর। যুবভারতীতে মোহনবাগান টিমবাস থেকে নামছিলেন সনি, কাতসুমি, বলবন্তরা। ঠিক তখন পার্শ্ববর্তী র্যাম্প থেকে টুক করে উড়ে এল কথাটা। ‘পায়ে বল হাতে টাকা/ বল এ বার গোলে ঢোকা।’
ড্রেসিংরুমে সনি নর্ডিকে তাঁর কোনও বাংলাভাষী সতীর্থ কথাটা তর্জমা করে দিয়েছিলেন কি? ভারতের মাটিতে প্রথম গোল করে স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্নটা শুনে হাসি চাপতে পারছিলেন না সনি। বললেন, “আই লিগের প্রথম ম্যাচে সেই যুবভারতীতেই গোল পেলাম। টিমও জিতল। মনে হচ্ছে ছন্দে ফিরতে পারব।” গাড়ির দরজা বন্ধ করার ফাঁকে আরও বলে গেলেন, “ভারতের মাটিতে আমার প্রথম গোলটা উত্সর্গ করছি মোহনবাগান সমর্থকদের। কারণ ট্রফি না পাওয়া হতাশ মুখের কষ্ট আমি বুঝি!”
আই লিগে প্রথম ম্যাচে সবুজ-মেরুনের শেষ জয় তৃণমূল সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার বছরে। তার পরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও গঙ্গাপারের তাঁবু আই লিগের প্রথম ম্যাচে আর পুরো তিন পয়েন্ট পায়নি। তাই তেরো মিনিটে এ দিন যখন কাতসুমির শীতল মগজের বদান্যতায় সঞ্জয় সেনের দল ১-০ এগিয়ে গেল তখনও হাত তুলে উদ্বাহু নৃত্য করেননি সমর্থকরা। কারণ সেই গোলটাও যে এসেছিল ম্যাচের ১৩ মিনিটে। সবুজ-মেরুন সমর্থকদের মনে কি তখন তেরোর গেরোয় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল?
দিনের শেষে অবশ্য দাপটের সঙ্গে খেলেই মহার্ঘ তিন পয়েন্ট নিয়ে ফিরতে পারলেন বাগান সমর্থকরা। জোড়া গোল করে ম্যাচের সেরা হতে পারেন কাতসুমি (তার পরেও স্টেডিয়াম ছাড়েন কোনও কথা না বলে)। কিন্তু নেপথ্য নায়ক চেতলার বঙ্গসন্তান কোচ সঞ্জয় সেন। ‘ডরপোক’ নন। কেঁপে যান না সহজে। ফুটবলার জীবনে রেলওয়ে এফসি-র হয়ে বড় দলের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন। তরুণ বয়সে নিউ মার্কেটে একদল দুষ্কৃতীকে রাস্তায় একা ঠেঙিয়ে চিত্পাত করেও দিয়েছেন একটা সময়। প্রথম বার বড় দলে কোচিং করাতে এসে সেই ‘মাস্তানি’টা জারি রেখেছেন সঞ্জয়।
ফেড কাপ থেকে শূন্য হাতে ফেরা। ক্লাবের অভ্যন্তরীণ ডামাডোল। বকেয়া বেতন। এত সব সমস্যা তো ছিলই। তার সঙ্গেই বাগান কোচের রক্তচাপ কিন্তু ভক্তচাপেও বেড়ে যায়নি। বরং উইথড্রল ফরোয়ার্ড খেলতে ইচ্ছুক কাতসুমিকে শত অনুরোধেও উইং থেকে সরাননি। ৪-৩-৩ ছকের মোক্ষম স্ট্রাইকার সনিকে ৪-৪-১-১-এও তাঁর পছন্দের লেফট উইংয়ে না খেলিয়ে সেই স্ট্রাইকারেই রেখেছেন। শৃঙ্খলা মানা যাঁর তেমন ধাতে নেই সেই তরুণ প্রতিভা মণীশ ভার্গবের মননে উইং ধরে অপারেট করার অঙ্ক ঢুকিয়ে দেওয়া, রক্ষণে বেলোকে নেতৃত্বে আনা বাগান কোচ সব করেছেন এক সপ্তাহ সময়ে। যার নিট ফল, এ দিনের ঝলমলে সবুজ-মেরুন হাসিমুখগুলো।
ভাগ্যও সব সময় সাহসীদের সহায় হয়। শনিবার ‘পেশাদারিত্ব’ দেখিয়ে বোয়ার বসে যাওয়াটা এ দিন ‘সোনে পে সোহাগা’ হয়ে গিয়েছিল বাগান কোচের। বোয়া বিপক্ষের আক্রমণের সময় নামতে পারেন না। মাঝমাঠ আর ফরোয়ার্ডের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয় তা কাজে লাগায় বিপক্ষ। এ দিন বোয়ার অনুপস্থিতিতে টিমটা দাঁড়িয়ে যায়নি। সনি আর বলবন্ত পালা করে নেমে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন মুম্বইয়ের কুট্টিমণি বা প্রদীপদের গায়ে।
৪-৫-১ ছকে মুম্বই এফসি আক্রমণের ইউএসপি দুটো। এক) জোসিমারকে ওভারহেড বল ফেলা। ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার বল হোল্ড করার সময় তাইসুকে আর জয়েশ দু’প্রান্ত দিয়ে উঠে এসে চাপ বাড়াবে বিপক্ষ রক্ষণে। দুই) পেনিট্রেটিভ জোনে থ্রো বা কর্নার থেকে জোসিমারের উচ্চতা আর গুঁতোগুঁতির ফায়দা তোলা। খালিদ জামিলের টিমের গোলটাও এ দিন ওই দ্বিতীয় রাস্তা ধরেই। যদিও বাগান শিবিরের দাবি বলটা আগেই থ্রো হয়ে গিয়েছিল। উল্টে রেফারি তেজস নাগভেঙ্কর নাকি থ্রো দেন মুম্বইয়ের দলকে।
তবে বল-সহ ও বল ছাড়া দুরন্ত গতি, ছোট জায়গায় চকিতে টার্নিং, আউট সাইড, ইনসাইড ড্রিবল কাজে লাগিয়ে কাতসুমির পাল্টা দাপটে বেশি দাঁত ফোটাতে পারেনি মুম্বই এফসি। সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁদের কোচ হতাশ মুখে বলে গেলেন, “এই ম্যাচটা ভুলে যেতে চাই। গোল শোধ করেও ফের পিছিয়ে পড়লাম। সনির গোলটা আমাদের ভুলেই।”
কাতসুমির সঙ্গে সবুজ-মেরুন জার্সিতে এ দিন ঝলমল করলেন আগরপাড়ার বঙ্গসন্তান তীর্থঙ্কর আর বিক্রমজিত্। পরে নেমে মণীশ ভার্গবও। তিন জনকে কাটিয়ে মণীশের মুম্বই বক্সে ফেলা বল থেকেই কাতসুমির দ্বিতীয় গোল।
বাগানের পরের ম্যাচ ২৮ জানুয়ারি গোয়ায় সালগাওকরের বিরুদ্ধে। যাদের কাছে চার গোল হজম করে ফেড কাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল সঞ্জয়কে। ফলে এ বার ম্যাচের আগে কয়েকটা জায়গায় মেরামতির চিন্তা বাগান কোচের মাথায় ঘুরলে অবাকের নেই। শিল্টনের মেজাজ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে লেফট ব্যাকে সৌভিক ঘোষের গতি-মন্থরতা সারানো। নিজেদের বক্সে বল ক্লিয়ারের সময় সেকেন্ড বলটা ধরতে ডেনসনদের উদ্যোগ বাড়ানো।
তা হলে হয়তো এক মাসের মধ্যেই গোয়ায় গিয়ে পাল্টা জবাব দিয়ে আসতে পারে মোহনবাগান।
মোহনবাগান: শিল্টন, প্রীতম, কিংশুক, বেলো, সৌভিক, কাতসুমি (সৌভিক চক্রবর্তী), ডেনসন (শেহনাজ), বিক্রমজিত্, তীর্থঙ্কর (মণীশ) বলবন্ত, সনি।