সুখের সেই দিন। ২০০২। বাগান উৎসবে আর সি প্রকাশ (বাঁ দিকে)।
আলমারিতে সযত্নে তুলে রাখা তেরো বছরের পুরনো সেই সতেরো নম্বর জার্সিটা পরেই রবিবার মাঠে আসবেন রবিচিক্কন প্রকাশ!
সেই ছোট্টখাট্টো চেহারার দ্রুতগতির স্ট্রাইকার আর সি প্রকাশ।
তেরো বছর আগে মোহনবাগানকে যাঁরা শেষবার জাতীয় লিগ এনে দিয়েছিলেন তাঁদের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে হাজির থাকছেন এই বেঙ্গালুরুবাসী ফুটবলার। শিল্টন পালদের হাতে ফের ট্রফিটা দেখার খিদে নিয়ে।
‘‘লিগে সে বার বারো গোল করেছিলাম। গোটা মরসুমে ছত্রিশটা। তবুও কর্তারা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পুরো টাকাও দেননি। প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছিল। তার পর কলকাতায় বহুবার গেলেও তীব্র অভিমানে আর কখনও মোহনবাগান তাঁবুতে পা রাখিনি।’’ বিবেকনগরের বাড়িতে বসে বলছিলেন এক যুগেরও আগে ব্যারেটো, সেরিকি, দেবজিৎ ঘোষদের সঙ্গে সবুজ-মেরুন তাঁবুতে আলো এনে দেওয়া প্রকাশ।
অরুময় নৈগম, উলগানাথন-সহ মোহনবাগানের অনেক প্রাক্তন বেঙ্গালুরু তারকাই সনি-কাতসুমিদের চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ দেখতে রবিবার স্টেডিয়ামে আসছেন। কিন্তু আর সি প্রকাশের আশার ব্যাপারটা অন্য মাত্রা পেতে চলেছে। কারণ, তিনিই সিটি অব গার্ডেন-এর একমাত্র ফুটবলার যিনি বাগানকে জাতীয় লিগ জিতিয়েছেন। ‘‘আসলে মোহনবাগানে খেলেই তো তারকা হয়েছি। পুরনো ক্লাবের ক্ষোভ থাকলেও সেটা ভুলি কেমন করে। ওই মরসুমের পরের বছরই ডেম্পোকে জাতীয় লিগ জিতিয়েছিলাম গোল করে। তা সত্ত্বেও আমার জীবনের সেরা স্মৃতি বাগানকে লিগ দেওয়াটাই। বলতে পারেন সেই স্মৃতিটা ফের জাগিয়ে তোলার জন্যই সে বারের জার্সিটা গায়ে দিয়ে রবিবার মাঠে যাব। একটা সবুজ-মেরুন ফ্ল্যাগের খোঁজেও আছি।’’
এ দিনই কলকাতা থেকে ফোনে তেরো বছর আগে বাগানে প্রকাশের কোচ সুব্রত ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা ভাল স্ট্রাইকার ছিল। গোলটা চিনত। প্রচণ্ড গতি ছিল। তবু ওকে সে বার ব্যারেটো-সেরিকির পিছনে খেলাতাম। তাতেও অনেক গোল করেছিল। ওর গোলে সেই মরসুমে অনেক ম্যাচে জিতেছি।’’
সুব্রতর সঙ্গে তার পরে আর কখনও দেখা হয়নি বেঙ্গালুরু ফুটবল মহলে অন্যতম জনপ্রিয় এই ফুটবলারের। বারবার জানতে চাইছিলেন, ‘‘বাবলু স্যর খেলা দেখতে আসবেন না?’’ বাগান থেকে দুর্ভাগ্যবশত বাতিল হয়ে ডেম্পো, মহীন্দ্রায় খেলার পর স্থানীয় প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্লাব সিআইএলেও খেলেন প্রকাশ। সামনের মরসুমে কোচিং করাবেন বলে ইতিমধ্যেই চুক্তি করে রেখেছেন সাদার্ন ব্লুজ ক্লাবের সঙ্গে। চাকরি করেন না। ফুটবলকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। কথা বলতে বলতে আরও স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন, ‘‘সে বার শেষ ম্যাচ না জিতলেই আমাদের ট্রফি হাতছাড়া হত। এ বার তো তবু বিকল্প রয়েছে—ড্র করলেও চ্যাম্পিয়ন। জিতলে তো বটেই। তবু আমি সনিদের বলব, গো ফর উইন। ড্রয়ের কথা ভাবলেই ডুববে।’’
এ বার আই লিগে বাগানের কোনও ম্যাচ স্বচক্ষে দেখেননি। তাই সনি, শিল্টন, বোয়া—কাউকেই চেনেন না। জানতে চাইলেন, ‘‘এ বারেরটা কি আমাদের সেই টিমের চেয়ে ভাল? ব্যারেটো-বাসুদার (বাসুদেব মণ্ডল) মতো ভাল ফুটবলার এ বার আছে?’’
নিজে কেএফএ-র দেওয়া কার্ডে ঢুকবেন মাঠে। কিন্ত দশ-বারো জন সঙ্গীর টিকিট এখনও জোগাড় হয়ে ওঠেনি। আই লিগ ‘ফাইনালের’ টিকিটের চাহিদা যে তুঙ্গে। রবিবার কান্তিরাভা স্টেডিয়ামের দু’টো ব্লক খুলে দেওয়া হচ্ছে আরও পাঁচ হাজার দর্শক বসাতে।
আর সি প্রকাশ সব ক্ষোভ ভুলে সামিল হতে চাইছেন বাগান-উৎসবে। আর নয় মাস আগে ঘোষিত ‘বাগানরত্ন’ এখনও হাতে না পেলেও রবিবার এখানকার মাঠে গলা ফাটাতে আসবেন অরুময় নৈগমও। ‘‘আরে ওটা পরে পেলেও চলবে। আগে তো এটা পাই,’’ বলছিলেন বাগানের ‘বেবি ট্যাক্সি’। আর উটি থেকে ছুটি কাটছাঁট করে শুধু এই ম্যাচটা দেখার জন্যই ঘরে ফিরছেন উলগাও। মহাম্যাচের তিন দিন আগেই বোঝা যাচ্ছে কলকাতা ছাড়িয়ে বাগান-আবেগ কী ভাবে সজোরে আছড়ে পড়তে চলেছে বেঙ্গালুরুতে।
স্থানীয় ফ্যানস ক্লাব ‘মেরিনার্স অ্যাট বেঙ্গালুরু’-র সদস্যরা ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন সবুজ-মেরুন ‘চ্যাম্পিয়ন্স গেঞ্জি’। সঙ্গে নৌকো, চিংড়ির বিশাল সব কাটআউট। রবিবারের জন্য। কিন্তু তাঁর পুরনো ক্লাব ফের লিগ জিতলে এই শহরের যেখানে যেমন উৎসবই হোক না কেন, তাতে সামিল হতে চান না আর সি প্রকাশ। তিনি নিজের মতো করে সেলিব্রেট করবেন।
সেটা কী? বাগানের শেষবার লিগ জয়ী দলের একমাত্র বেঙ্গালুরু প্রতিনিধি বলে দিলেন, ‘‘কী আবার! গা থেকে সেই জার্সিটা খুলে ওড়াব। যেটা তেরো বছর আগে উড়িয়েছিলাম মাঠের ভেতর। এ বার ওড়াব গ্যালারিতে।’’