আক্রমণাত্মক ফুটবল দেখাতে গিয়ে ডুবল মোরিনহোর দল

ফাইনালে মস্তিষ্ক বলছে রিয়াল হৃদয়ে কিন্তু আটলেটিকো

এল ডার্বি মাদ্রিলেনো! কলকাতার ফুটবল রসিকদের অভিধানে এ বার হয়তো ঢুকে পড়ল শব্দটা। বাংলা অর্থ— মাদ্রিদের ডার্বি। স্পেনের ফুটবল নিয়মিত টিভিতে দেখে, খবরের কাগজে পড়ে বাঙালি ফুটবল জনতা শিখেছে ‘এল ক্লাসিকো’— বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ। ‘এল মাদ্রিলেনো’ যে নতুন শব্দ তা-ও নয়। স্পেনের মানজানারেস নদীর তীরে মাদ্রিদ শহরের দুই ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং আটলেটিকো মাদ্রিদের গোলাপের যুদ্ধ।

Advertisement

সুব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

কোস্তাকে নিয়ে উদ্দাম আটলেটিকো।

এল ডার্বি মাদ্রিলেনো!

Advertisement

কলকাতার ফুটবল রসিকদের অভিধানে এ বার হয়তো ঢুকে পড়ল শব্দটা।

বাংলা অর্থ— মাদ্রিদের ডার্বি। স্পেনের ফুটবল নিয়মিত টিভিতে দেখে, খবরের কাগজে পড়ে বাঙালি ফুটবল জনতা শিখেছে ‘এল ক্লাসিকো’— বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ।

Advertisement

‘এল মাদ্রিলেনো’ যে নতুন শব্দ তা-ও নয়। স্পেনের মানজানারেস নদীর তীরে মাদ্রিদ শহরের দুই ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং আটলেটিকো মাদ্রিদের গোলাপের যুদ্ধ। আমাদের মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গলের মতোই। ২৪ মে এ বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের ক্যাচলাইন হতেই পারে ‘ফ্রম মাদ্রিদ টু হেভেন ভায়া লিসবন।’ রেকর্ড বইয়ের পাতা উল্টে দেখলাম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে এই প্রথম একই শহরের দু’দল ফাইনাল খেলবে। দেখে ভিতরে ভিতরে একটু নস্ট্যালজিকও হয়ে পড়ছি। মনে পড়ছে সত্তর, আশির দশকের কথা। যখন ভারতের বেশির ভাগ টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলত কলকাতার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। থাক সে সব কথা। আপাতত ঢুকে পড়ি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে।

কার্লো আন্সেলোত্তি বনাম দিয়েগো সিমিওনে। এক জনের অস্ত্র প্রখর ফুটবল-মস্তিষ্ক। অতীতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার অভিজ্ঞতা। আর এক জনের অস্ত্র নিজের জোশ, ইনভলভ্মেন্ট, শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের এতটুকু জমি না ছাড়া।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগে আন্সেলোত্তির রিয়াল যখন ‘লা ডেসিমা’-র (দশম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেতাব) খোঁজে, তখন সিমিওনেরও চ্যালেঞ্জ চল্লিশ বছর পর ইউরোপ-সেরা ক্লাবের খেতাব মাদ্রিদের ভিসেন্তে কালদেরন স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া।

এক দিকে, রোনাল্ডো-বেল-দি’মারিয়া-বেঞ্জিমাদের তারকাখচিত ব্রিগেড। অন্য দিকে, দিয়েগো কোস্তা-কোকে-দাভিদ ভিয়া-গাবিদের মরণপণ ফুটবল। আমার চেলসি-আটলেটিকো সেমিফাইনাল প্রিভিউয়ে এগিয়ে রেখেছিলাম মোরিনহোর দলকে। কিন্তু দুই মাদ্রিদের ফাইনাল লড়াইয়ে আমার ফেভারিট সে ভাবে কেউ নয়। হৃদয় বলছে, আটলেটিকো। আর মস্তিষ্ক বলছে, রিয়াল।

কেন হৃদয়ে আটলেটিকো? উত্তরটার নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আইএসএলে কলকাতার দলে সৌরভের সৌজন্যেই লা লিগার লাল-সাদা জার্সি আটলেটিকো ঢুকে পড়েছে প্রবল ভাবে। আর আমি আদ্যন্ত সৌরভ-ভক্ত। ও যদি স্পোর্টিং ইউনিয়ন টিমও নেয়, তা হলেও আমি ওর দলের হয়ে গলা ফাটাতে এক কথায় রাজি। কারণ, ও আমাদের রাজ্যের আইকন ক্রীড়াবিদ। বেহালার যে বঙ্গসন্তান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে দেশকে ম্যাচ জিতিয়েছে বহু বার, তার সমর্থক না হয়ে পারা যায় না কি?

কিন্তু উল্টো দিকে যে সব ভারী ভারী নাম! কে জানত, বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে রোনাল্ডো নব্বই মিনিটেও ফ্রিকিক থেকে বিপক্ষ ওয়ালের পায়ের তলার ওই সূক্ষ্ম জায়গা দিয়ে গোলে পাঠিয়ে দেবে? বেলের গতি দেখলেই তো উসেইন বোল্টের কথা মনে পড়ে যায়! চোখে ভাসে কোপা দেল রে সেমিফাইনালে বার্সেলোনার বিরুদ্ধে করা ওর গোলটা। সঙ্গে দি’মারিয়ার চমৎকার বল কন্ট্রোল, পাসিং, ক্রস। যার জন্য বিপক্ষ বক্সে চিতাবাঘের মতো ওঁত পেতে থাকে করিম বেঞ্জিমা। সুযোগ পেলেই গোল!

সেমিফাইনালে তোরেসের গোলে এগিয়ে গিয়েও মোরিনহো অ্যাশলে কোলকে তুলে নিয়ে আটলেটিকোকে চাপে ফেলতে স্যামুয়েল এটোকে নামিয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যা ব্যুমেরাং হয়ে গেল ওর কাছে। এডেন হ্যাজার্ডরা রক্ষণটা ঠিক মতো গুছিয়ে রাখতে পারল না। ওদের ব্যর্থতাতেই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে এ বারের মতো ছুটি হয়ে গেল চেলসির। আমার তো মনে হয়, মোরিনহো তার সমালোচকদের সে দিন তোরেসের গোলটার পর কিছু জবাব দিতে গিয়েছিলেন। কারণ, গোটা বিশ্ব জুড়েই মোরিনহোর আল্ট্রা ডিফেন্সিভ ফুটবল নিয়ে হাজার কচকচি। তাই বোধহয় স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে এটোকে নামিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল, আমিও অ্যাটাকিং ফুটবলটা খেলাতে জানি। তাই তিন ব্যাকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এ রকম ফাটকা খেলতে গেলে একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। তারই মাশুল দিতে হয়েছে ফুটবল দুনিয়ার ‘দ্য স্পেশ্যাল ওয়ান’কে।

২৪ মে লিসবনের রাতটা কোন মাদ্রিদের মুখে হাসি রাখবে! এই প্রতিবেদন লেখার আগে স্প্যানিশ ফুটবল নিয়ে একটু হোমওয়ার্ক করছিলাম। তখনই চোখে এল দুই ক্লাবের আকচাআকচি সম্পর্কের কথা। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সময়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধ যা আরও বাড়িয়ে দেয়। আজও তাই মাদ্রিদ ডার্বি-র সময় আটলেটিকোর সমর্থকরা গ্যালারিতে রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়েই বরং গান গায়। যার সারমর্ম— সরকারের টিম, দেশের লজ্জা।

নিজে একটুআধটু ফুটবল খেলেছি বলেই জানি, এই ধরনের ম্যাচে লড়াইটা সব সময় মনস্তাত্ত্বিক হয়ে দাঁড়ায়। তবে কাউন্টার অ্যাটাকে সিমিওনের দল বেশ পোক্ত। রিয়ালের পুরনো দিনের ভারসাম্যের ফুটবলকে মাথায় রেখেই কথাটা বলছি। কারণ ব্রাজিলজাত দিয়েগো কোস্তা কাউন্টার অ্যাটাক স্ট্রাইকার হিসেবে বিশ্বে প্রথম তিনে থাকবে। ও হয়তো ভাল পেনাল্টি বক্স স্ট্রাইকার নয়। কিন্তু সুযোগ পেলে তা ঠিক কাজে লাগিয়ে দেয়। উইং ধরে ওদের ছোট-ছোট পাসে বিপক্ষ রক্ষণে হানা দেওয়াটাও বেশ ভয়ঙ্কর। উল্টে সেমিফাইনালে না খেলা গাবি ফিরবে আটলেটিকো মাঝমাঠে। ওর ডিস্ট্রিবিউশন সমীহ জাগানোর মতোই। জাবি আলোন্সো মিডফিল্ডে না থাকায় একটা সমস্যা হতেই পারে রিয়ালের। যদিও মোরিনহোর দলের রক্ষণের মতো কার্ভাজাল, কোয়েন্ত্রাও, পেপে, র্যামোসরিয়ালের ব্যাক ফোর বিপক্ষকে অতটা ভয়ঙ্কর হতে দেবে বলে মনে হয় না।

দর্শক বিধ্বস্ত মোরিনহোর।

এ মরসুমে লা লিগা আর কোপা দেল রে মিলিয়ে চার বার মুখোমুখি হয়েছে রিয়াল-আটলেটিকো। রিয়াল ২-১ এগিয়ে। ড্র এক বার। এ বার যদি ইউরোপ সেরা ক্লাবের খেতাব ভিসেন্তে কালদেরনে যায় তা হলে কিন্তু যাবে ওই এক জনেরই জন্য। তার নাম দিয়েগো সিমিওনে। ওর জন্যই আটলেটিকো এত ঝলমলে। ওই ক্লাবে ও খেলেছেও। দলের মানসিকতাটা ভালই বোঝে। তাই যে দলটা লা লিগায় কয়েক বছর আগেও অবনমন জোন-এ থাকত, সেই দলটাকেই আমূল বদলে দিয়েছে সিমিওনে ওর হার না মানা মানসিকতা দিয়ে। কোকে, গাবিরাও একই কথা বলেছে, সেমিফাইনাল শেষ হওয়ার পর। বার্সেলোনা এবং চেলসি কারও বিরুদ্ধেই কিন্তু ওরা হারেনি এ মরসুমে। যে কোচ নিজেই বলে, “আর্থিক ভাবে অন্য দলের চেয়ে পিছিয়ে থাকতে পারি। কিন্তু মোটিভেশনে এতটুকু পিছিয়ে থাকব না,” তাঁর দল ম্যাজিক দেখাতেই পারে। ফাইনাল ম্যাচটা তাই আমার কাছে রিয়াল ৫১:আটলেটিকো ৪৯।

এক যুগ আগে রিয়ালের বর্তমান সহকারী কোচ জিনেদিন জিদানের ভলিতে বের্নাবাওতে শেষ বার ঢুকেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। আর চল্লিশ বছর আগে স্পেনের প্রয়াত প্রবাদপ্রতিম কোচ লুই আরাগোনেস আটলেটিকোকে এনে দিয়েছিলেন বহু প্রতীক্ষার এই তাজ। সেই তালিকায় এ বার কে ঢুকবে? লা ডেসিমা-র মুকুট পরা রোনাল্ডো, না ইতিহাস তৈরি করা কোস্তা? ফুটবলদুনিয়া কাঁপানো উত্তরটা জানতে অপেক্ষা মাত্র বাইশটা দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন