উৎসবের পবিত্রভূমিতে নয়্যার সুপারম্যান, ওজিলের নাচ

ফ্যানহানসা থেকে নেমে বিমানবন্দরেই ‘গার্ড অব অনার’

পশ্চিম বার্লিন থেকে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তাটার নামই হয়ে গিয়েছে ‘ফ্যান মাইল’। ২০০৬ বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় আনুষ্ঠানিক নামকরণ। তার পর থেকে জার্মানদের যাবতীয় উৎসবের বিশাল মণ্ডপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৪-র এক রোদ-ঝলমলে মঙ্গলবার সকালে যেন পূর্ণতা পেল জার্মান ফুটবল-ভক্তদের এই পবিত্রভূমি। লাল, কালো আর সোনালির অন্য তেরঙার সমুদ্রে ভেসে গেলেন জার্মান ফুটবল দেবতারা। তাঁদের কারও নাম ফিলিপ লাম, কারও নাম বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগার, কেউ ম্যানুয়েল নয়্যার, কেউ মারিও গোটজে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০২:২০
Share:

বার্লিনের আকাশে অন্য তেরঙা। ফাইনালের নায়ক মারিও গোটজের সঙ্গে আন্দ্রে শুরলে।

পশ্চিম বার্লিন থেকে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তাটার নামই হয়ে গিয়েছে ‘ফ্যান মাইল’। ২০০৬ বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় আনুষ্ঠানিক নামকরণ। তার পর থেকে জার্মানদের যাবতীয় উৎসবের বিশাল মণ্ডপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৪-র এক রোদ-ঝলমলে মঙ্গলবার সকালে যেন পূর্ণতা পেল জার্মান ফুটবল-ভক্তদের এই পবিত্রভূমি। লাল, কালো আর সোনালির অন্য তেরঙার সমুদ্রে ভেসে গেলেন জার্মান ফুটবল দেবতারা। তাঁদের কারও নাম ফিলিপ লাম, কারও নাম বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগার, কেউ ম্যানুয়েল নয়্যার, কেউ মারিও গোটজে।

Advertisement

উৎসবের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল সোমবার রাত থেকেই। প্রিয় নায়কদের একটু কাছ থেকে দেখার জন্য সারা রাত রাস্তায় কাটিয়ে দেওয়া কী এমন বড় দাম! বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বাহক লুফ্তহানসার বিমান বার্লিনের আকাশে উদিত হওয়ামাত্র ফেটে পড়ে গোটা শহর। দেখে কে বলবে, ট্রফি তখনও পর্যন্ত বার্লিনের সূর্যের ছোঁয়া পায়নি! বোয়িং ৭৪৭ বিমানটার গায়ে ‘লুফ্তহানসা’র জায়গায় লেখা নতুন সৃষ্ট একটা শব্দ ফ্যানহানসা! তার পাশে আবার সোনালি হরফে লেখা ‘সিগারফ্লিগার’। চ্যাম্পিয়নদের প্লেন!

বিমানের চাকা রানওয়ে ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজির লাল টুকটুকে ফায়ার ট্রাক। সাদা মেঘের মতো ধোঁয়া উড়িয়ে যারা দেশের প্রিয়তমদের অভিনব গার্ড অব অনার দিল। ট্রফি নেওয়া ফিলিপ লামের পিছনে যখন একে একে বেরিয়ে আসছেন বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগার, সামি খেদিরা, টনি ক্রুজরা, টেগেল বিমানবন্দরে তখন মানুষের ঢল। সেখান থেকে মার্সিডিজ বেঞ্জের বিশাল কালো বাসের ছাদে উঠে, হাজার হাজার ভক্তের ভিড় চিরে সোজা ব্রান্ডেনবুর্গ গেট। ভালবাসার চলমান সমুদ্রের ঠিক মধ্যিখানে!

Advertisement


ভক্তদের সমুদ্রে যেন ভাসমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বাস।

গেটের সামনে তৈরি জায়ান্ট স্ক্রিন আর অস্থায়ী মঞ্চের উপর জড়ো হওয়া জাতীয় নায়কদের দেখার জন্য উপচে পড়া জার্সি-পতাকা-পরচুলা-ব্যান্ডানার যে ভিড়, সংখ্যায় ধরে রাখতে চাইলে অঙ্কটা দাঁড়াবে দশ লাখ বা তার একটু বেশি। আবেগের অণুবিশ্বে বোধহয় এ দিন হাজির ছিলেন অবিভক্ত জার্মানির প্রতিটি নাগরিকই। উনিশ বছরের লুক যেমন। বস্কে ‘আমি অসুস্থ’ বলে সারা রাত ড্রাইভ করে উত্তর জার্মানির ব্রেমেন শহর থেকে ছুটে এসেছেন। বা এক সময়কার পূর্ব জার্মানির বাসিন্দা গান্থার রিখটার। ইহজীবনে এই দিন চাক্ষুষ করতে পারবেন, স্বপ্নেও যিনি ভাবেননি।

মঙ্গলবার সকালের অনুষ্ঠানটাও প্রায় স্বপ্নের মতো হয়ে থাকল অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, কার্ল মার্কসের দেশের কাছে। নব্বইয়ের বিশ্বকাপ জয়ের পর তাদের দেশে এটাই বৃহত্তম উৎসব। বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাতীয় গ্লানি ভুলে, ‘জার্মান জাত্যভিমান’ শব্দদ্বয় থেকে যাবতীয় কালিমা মুছে বিশ্বের কাছে সদর্পে ঘোষণা করার দিন হ্যাঁ, আমরা জার্মানি! আমরা বিশ্বজয়ী!


নাচের ফাঁকে তেষ্টা মেটাচ্ছেন ম্যানুয়েল নয়্যার।

মেসুট ওজিল, বোয়াতেংদের নাচ, নয়্যারের সুপারম্যান-সম লাফ, গানবাজনা, ট্রফি নিয়ে অধিনায়ক লামের খুনসুটি, জায়ান্ট স্ক্রিনে মারাকানার ফাইনালের হাইলাইটস, মারিও গোটজে-আন্দ্রে শুরলেদের দেদার সেলফি তোলা, শ্যাম্পেনের বিশাল বোতল সোজা গলায় উপুড় করে দেওয়া নয়্যারের কী ছিল না মঙ্গলবারের মায়াবী মঞ্চে! জোয়াকিম লো, যাঁকে বিশ্বকাপে কালো শার্ট আর ধুসর ট্রাউজার ছাড়া খুব একটা দেখা যায়নি, তিনিও তো জিনস-টি শার্টে এ দিন ব্যতিক্রমী!

ভক্তদের সমুদ্র থেকে গর্জনের মতো ভেসে আসছে একটা একটা করে নাম। কখনও মারিও, কখনও বাস্তিয়ান, কখনও ইয়োগি লো। রবিবার মারাকানায় ১১৩ মিনিটে যে পার্টি শুরু হয়েছিল, তা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছল মঙ্গলবারের বার্লিনে। এটা তো বাড়াবাড়ি করারই দিন! গত এক মাসে সাতটা পার্টির সাক্ষী থেকেছে ফ্যান মাইল। গ্রুপ লিগের তিনটে ম্যাচ, তার পর তিনটে নকআউট ম্যাচ আর সব শেষে ফাইনাল জয়ের পার্টি। কিন্তু আবেগ আর উচ্ছ্বাসের রিখটার স্কেলে মঙ্গলবারের সকাল বোধহয় আগের সবগুলোকে ছাড়িয়ে গেল।


নীল-সাদা যখন ফিকে। দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মেসি।

যার কয়েক ঘণ্টা আগে অন্য এক মহাদেশে বুয়েনস আইরেস বরণ করে নিয়েছে তার পরাজিত নায়কদের। লিওনেল মেসিদের প্লেনের রংও ছিল দেশের নীল-সাদায় রাঙানো। কিন্তু সেই প্লেনের গায়ে শুধু লেখা ধন্যবাদ আর্জেন্তিনা। আলেজান্দ্রো সাবেয়া-সহ মেসিদের আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির ছিলেন প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা কির্চনার। মিডিয়ার সেখানে প্রবেশ নিষেধ। “আমরা নিজেদের সব কিছু দিয়েছি,” দেশে ফিরে বলেন সাবেয়া। জাভিয়ের মাসচেরানোর কথায়, “চেয়েছিলাম অন্য ভাবে দেশে ফিরব।” মেসি? না, তিনি মুখ খোলেননি। যা বলার তাঁর ফ্যাকাশে মুখই বোধহয় বলে দিয়েছে।

বিশ্বসেরা যে দিন অন্য কারও ইতিহাস বইয়ের ফুটনোট হয়ে যান, সে দিন তাঁর কী-ই বা বলার থাকে!

ছবি রয়টার্স, এএফপি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন