ধবন বনাম ওয়ার্নার
বিল লরির বিখ্যাত সেই মন্তব্য! টিভি ধারাভাষ্যে লরি দীর্ঘকাল ব্যবহার করতে করতে যা এক রকম তাঁর পেটেন্ট।
ইট ইজ অল হ্যাপেনিং আউট দেয়ার ইন দ্য মিডল। যা কিছু ঘটছে সব মাঠের মাঝখানেই।
শুক্রবারের ক্ষেত্রে মন্তব্যটা আক্ষরিক ভাবে সত্যি। যা হচ্ছিল মাঠের মধ্যিখানে সকলের চোখের সামনেই ঘটছিল।
এ দিন ছিল অ্যাডিলেড ওভালের একশো তিরিশতম বার্ষিকী। এটা ভারতীয় মাঠ নয় যে কবে জন্ম, কবে মৃত্যু কেউ খেয়াল রাখে না। ক্রিকেটের অন্তর্লীন রোমান্স আজও বিশ্বে যদি কোথাও বেঁচে থাকে, অস্ট্রেলিয়াতেই আছে। বারবার তাই ঘোষিত হল ওভালের আজ জন্মদিন। কে জানত সেই জন্মদিনেই এমন উত্তপ্ত বাতাবরণ তৈরি হবে যে ফিল হিউজ স্পিরিট কোথায় উড়ে গিয়ে সাময়িক ফেরত আসবে মাঙ্কিগেটের বিষাক্ত ধোঁয়া।
আজকের কাহিনিতে কোনও হরভজন নেই। কোনও সাইমন্ডস ছিলেন না। কেউ কাউকে বাঁদরও বলেনি। কিন্তু এমন টেনশন তৈরি হল যা এ দেশে সচিনদের শেষ সিরিজেও ঘটেনি। একমাত্র তুলনা সেই মাঙ্কিগেট।
যখন ডেভিড ওয়ার্নার আম্পায়ারের চোখের সামনে ধাক্কা দিলেন শিখর ধবনকে। গালাগাল দিলেন বরুণ অ্যারনকে। এর পর স্টিভ স্মিথের সঙ্গে যখন রোহিত শর্মার কথা কাটাকাটি চলছে, হঠাত্ই ওয়ার্নার অন্য প্রান্তের উইকেট থেকে দৌড়ে এসে গুঁতিয়ে ঢুকে পড়লেন সেখানে। এ বার বিরাট কোহলির সঙ্গে লাগল তাঁর। প্রায় ধাক্কাধাক্কি হওয়ার জোগাড়। ফুটবল হলে লাল-হলুদ কার্ড পরিস্থিতি। দুই আম্পায়ার এগিয়ে এসে শান্ত করলেন। লাঞ্চ থেকে খেলা শেষ হওয়া— অন্তত তিন বার এমন ঝামেলা হল যে প্রতি বারই পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে মাঠের আইনরক্ষকদের মধ্যস্থতা করতে হল।
পরিস্থিতি তাতছিল সকাল থেকেই। যখন নাথন লিয়ঁর বলে পরপর ব্যাট-প্যাড অ্যাপিল করে যাচ্ছিলেন অস্ট্রেলীয়রা। কিপার ব্র্যাড হাডিন আবেদন করছেন না এমন সব অ্যাপিলও জোর গলায় হচ্ছিল। এ রকমই একটা অ্যাপিলে আউট ঘোষণা করা হয় ঋদ্ধিমান সাহাকে। এর পর অস্ট্রেলীয় ইনিংসে যখন লড়াই জমে গেছে। বোঝা যাচ্ছে ওয়ার্নারকে আউট না করতে পারলে ভারত ম্যাচ থেকে ছিটকে যাবে— এই সময় বরুণ অ্যারন তাঁকে বোল্ড করেন। প্রচন্ড চিত্কারের মধ্যে ওয়ার্নার ফিরে যাচ্ছেন। বোলার তাঁকে প্যাভিলিয়নে ফেরার উত্তেজিত সঙ্কেত দিয়েছেন, এই অবস্থায় টিভি রিপ্লেতে ধরা পড়ে-- বরুণের বাঁ পা বোলিং ক্রিজের অনেকটা বাইরে। মানে নো বল। ওয়ার্নার তখন ফেরত আসতে থাকেন আর দূর থেকে গালাগাল দেন বোলারকে। মুহূর্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। ছুটে আসেন শিখর ধবন।
টিম শিখরের নামকরণ করেছে গব্বর। টিমের মজলিশ-টজলিশে তিনি নিয়মিত গব্বরের ডায়লগও বলেন। জো ডর গয়া, সমঝো মর গয়া। তেরা ক্যায়া হোগা রে কালিয়া। তা সেই গব্বর এগিয়ে আসেন বরুণের সাহায্যে। ওয়ার্নার তেড়ে যান তাঁর দিকে। ছুটে আসেন কোহলি। দেখা যায়, তাঁর সঙ্গেও বাঁ হাতি ওপেনারের একপ্রস্থ তর্কাতর্কি হচ্ছে। ওয়ার্নার তখন ৬৬। পরে ওয়ার্নার বললেন, “ওই চল্লিশ ডিগ্রি গরমে উইকেট-টুইকেট না পড়ায় বোলারের মেজাজ এমনিতেই রুদ্রমূর্তি। সেখানে আমি ওই উত্তেজিত করা কথাটা না বললেই পারতাম।”
পরে যাই বলুন, মাঠের মধ্যে অস্ট্রেলীয় তারকা ওপেনার বারবার তিনি এমন ইন্ধন জোগালেন, যা দেখলে প্রশ্ন উঠবে তা হলে আর প্রিয় বন্ধুর স্মৃতির জন্য খেলাটেলা কোথায়? এই তো সেই পুরনো অজি জঙ্গি মেজাজ!
ওয়ার্নার যখন ৬৮, লেগ সাইডে দুর্দান্ত ঝাঁপিয়ে তাঁর ক্যাচ ধরেন ঋদ্ধিমান। চ্যানেল নাইন, যাদের এখন অন্তরালে টিম অস্ট্রেলিয়ার টুয়েলভ্থ ম্যান বলছে ভারতীয় ক্রিকেট মহল। তারা অবধি দেখাল পরিষ্কার স্নিক। অথচ আম্পায়ার আউট দিলেন না। ঋদ্ধিমানের খুব খারাপ দিন গেল অ্যাডিলেড ওভালের জন্মদিনে। তাঁকে বাজে আউট দেওয়া হল আবার দুর্দান্ত ন্যায্য ক্যাচও নাকচ। ঋদ্ধি প্রকাশ্য অসন্তুষ্টি দেখাননি কিন্ত বাকি টিম বারবার আম্পায়ারকে আবেদন করতে থাকে। কিছু পরে ওয়ার্নার যখন ১০০ পূর্ণ করলেন, ভারতীয় দলে বরুণ অ্যারন ছাড়া কেউ হাততালি দেয়নি। বরুণও দিলেন ব্যঙ্গাত্মক ভাবে। মাঠে তখন ভারতীয়দের উদ্দেশে ব্যঙ্গাত্মক আওয়াজ উঠছে। অল্প পরে রোহিত শর্মার বলে স্টিভ স্মিথের এলবিডব্লিউ আবেদন নাকচ হওয়া নিয়ে বোলার-ব্যাটসম্যানে তর্ক বাধে। সেখানেই থেমে যেত। হঠাত্ উল্টো দিক থেকে দৌড়ে আসেন ওয়ার্নার। এ বার কোহলির সঙ্গে কথা কাটাকাটি আবার ধবনকে ধাক্কা— পুরনো নাটক শুরু হয়ে যায়।
ওয়ার্নার পরে বললেন, “ওদের মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। ওই ভাবে নো বল ঘোষণা হওয়ায়। ভারতীয়দের হতাশা সহজবোধ্য।” কিন্তু তিনি যা করলেন, তাতে কি ম্যাচে বহমান থাকা ফিল হিউজ স্পিরিটটাই মলিন হয়ে গেল না? ওয়ার্নার বলেন, “না না। আমরা বরাবর কঠিন ভাবে নিয়মের মধ্যে থেকেই ক্রিকেট খেলি।। মাঠে যে বাক্য আদানপ্রদান হয়েছে ওইটুকু তো হয়েই থাকে।” ভারতের পক্ষে মিডিয়ার সামনে এসেছিলেন অজিঙ্ক রাহানে। তিনি নিশ্চয়ই দুষবেন ওয়ার্নারকে।
কী ব্রিফিং নিয়ে যে রাহানে এসেছিলেন বোঝা গেল না। কারণ, তিনি উল্টে বললেন, “আম্পায়াররা দারুণ সামলেছেন। খেলায় এ সব হতেই পারে।” তাঁর এই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু রাহানে তিন বার বললেন, “এই সব তর্কাতর্কি-বচসা এইসব খেলার পক্ষে ভাল। আর ব্যাপারটা তো মিনিট কুড়ির বেশি চলেওনি।” তাঁর প্রেস কনফারেন্স শেষ হতে না হতেই ভারতীয় ড্রেসিংরুম রাহানের বিবৃতি শুদ্ধ করে দিয়ে বলল, “ও খেলার পক্ষে ভাল বলতে চায়নি। বলতে চেয়েছিল, এই জাতীয় ঘটনা খেলার অঙ্গ।”
সাংবাদিকরা সংশোধিত বিবৃতি লিখতে অস্বীকার করে বলেন, তিন বার বলার পর এখন বিবৃতি ঘোরাবার মানে কী? আর রাহানে কি বাচ্চা ছেলে না কি যে জানে না, কোথায় কী বলতে হবে? উঠে যাওয়ার আগে তো এটাও বলে গেল যে এমন ঘটনা আবার হবে এই সিরিজে। তা হলে আবার কীসের সংশোধন?
শেষ দিন ঘূর্ণি আর নিচু হয়ে যাওয়া অ্যাডিলেড পিচে অবশ্যই নাথন লিয়ঁ বল করার সময় বিস্তর আবেদন হবে। আবার না পরিস্থিতি তেতে যায়! যা দেখা যাচ্ছে, অ্যাডিলেড মাঠে হিউজের অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ অক্ষত থাকতে থাকতেই তো মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছে। কাল যারা কোহলির চোটে এমন সস্নেহে মাথার কাছে ঝুঁকে পড়েছিল, তাদের আজ এই রূপ কেন?
ওয়ার্নার ব্যাখ্যা করেন, “মাথায় লাগাটা আলাদা। ফিলের ঘটনার পর ওটা নিয়ে আমরা সব সময়ই সহানুভূতিপরায়ণ আর আতঙ্কিত থাকব। আজ যা হল ওটা অন্য জিনিস। হয়েই থাকে।”
দেখার হবে ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো কিছু ব্যবস্থা নেন কি না। প্লেয়াররাও আজ বাড়াবাড়ি হয়েছে বুঝে শেষ দিনে সংযত থাকবেন?
বিল লরির কথাটাই সামান্য সংশোধন হয়ে দাঁড়াবে— ইট ইজ অল হ্যাপেনিং আউট দেয়ার ইন দ্য মিডল অ্যান্ড ইনসাইড দ্য ড্রেসিংরুম। যা কিছু ঘটছে মাঠের মাঝখান আর ড্রেসিংরুমের অভ্যন্তরে!