বাবার উৎসাহেই ফুটবল কোচিংয়ে ভর্তি হন প্রহ্লাদ

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আর্মান্দো কোলাসোর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন। এলাকার লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর নাম। মঙ্গলবার কলকাতা ফুটবল লিগের মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর জালে বল জড়িয়ে দেওয়া ইস্তক উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরের আপাত অখ্যাত প্রহ্লাদ রায় আক্ষরিক আর্থে নায়কের সম্মান পাচ্ছেন।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

বেজায় খুশি মা-দাদা। মঙ্গলবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আর্মান্দো কোলাসোর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন। এলাকার লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর নাম। মঙ্গলবার কলকাতা ফুটবল লিগের মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর জালে বল জড়িয়ে দেওয়া ইস্তক উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরের আপাত অখ্যাত প্রহ্লাদ রায় আক্ষরিক আর্থে নায়কের সম্মান পাচ্ছেন।

Advertisement

সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরীক্ষা না দিয়ে প্রহ্লাদ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ খেলতে। বলা বাহুল্য প্রথমে বাড়িতে সে কাউকে কিছু বলেনি। ভাইয়ের মার্কসিট হাতে পেয়ে দাদা রবি রায় দেখেন, দু’টি বিষয়ে ভাই শূন্য পেয়েছে। জিজ্ঞাসা করলে মিথ্যের আশ্রয় না নিয়ে প্রহ্লাদ সে দিন সত্যিটাই বলেছিলেন। দাদা ক্ষেপে গিয়ে বাবা হীরালালবাবুর কাছে নালিশ জানান। তবে হীরালালবাবু ছেলেকে নিরস্ত করেননি। বরং সব শুনে প্রহ্লাদকে ফুটবল কোচিংয়ে ভর্তি করে দিতে বলেছিলেন। বাবার কথায় রবিবাবু ভাইকে অশোকনগরের একটি ফুটবল কোচিং সেন্টারে ভর্তি করেন।

“আপনারা এমন কিছু করবেন না, যাতে ওর মাথা ঘুরে যায়।” —রবি রায়

Advertisement

সেই শুরু। মাঝে দীর্ঘ লড়াই, পারিবারিক অনটনকে পিছনে ফেলে অদম্য জেদ আর পরিশ্রমের জেরে আজ ঠাকুরনগরের বঙ্গসন্তান আজ র্যান্টি-ডুডুদের মতোই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের চোখের মণি হয়ে হয়ে উঠেছেন।

প্রহ্লাদের বাড়ি গাইঘাটার ঠাকুরনগরে। বুধবার সকালে এলাকায় গিয়ে টের পাওয়া গেল ‘ঘরের ছেলে’র জনপ্রিয়তা। চায়ের দোকান থেকে বাজার, অফিসযাত্রী থেকে পথচারী সকলের মুখেই তাঁর নাম। সকালে ঠাকুরনগর বাজারে এক ব্যক্তি খবরের কাগজ হাতে একটি চায়ের দোকানে ঢোকেন। কাগজে প্রহ্লাদের ছবি বেরিয়েছে বলাতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল তা দেখতে। কোথায় বাড়ি, কে তাঁকে আগে চেনেন, তা হয়ে উঠল চর্চার বিষয়। ঘটনা হচ্ছে, মঙ্গলবার বিকেলের ওই ৯০ মিনিট টিভির পর্দা থেকে চোখ সরায়নি ঠাকুরনগর।

ঠাকুরনগরের খ্রিস্টান পাড়ায় ভাড়া বাড়িতে মা সাবিত্রীদেবী, দুই দাদা, বৌদি, ভাইপোকে নিয়ে থাকেন প্রহ্লাদ। বাবা মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগে। সাত ভাই-বোনের মধ্যে প্রহ্লাদ সর্বকনিষ্ঠ। সাবিত্রীদেবী নিজে ফুটবলের ভক্ত। তার উপরে ছেলে লাল-হলুদে দাপিয়ে খেলছে। বলছিলেন ‘‘আমার একটা ছেলে ফুটবলার হবে, এই স্বপ্ন বহু দিন ধরে লালন পালন করেছি। টিভিতে প্রহ্লাদের খেলা দেখে মনে হয়, সে স্বপ্ন আমার সার্থক হয়েছে।” টালিগঞ্জ ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে উপোস করেছিলেন তিনি।

সাবিত্রীদেবী জানান, খুব ছোটবেলা থেকেই শীতকালেও জার্সি গায়ে চাপিয়ে আর ফুটবল বুকে নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়তেন প্রহ্লাদ। সকালে ঘুম ভাঙলেই আবার বলের খোঁজ। স্বপ্নেও যে ভাই ফুটবল খেলতেন, পাশে শোওয়ার অভিজ্ঞতায় তা বহু বার টের পেয়েছেন দাদা যুগল। প্রহ্লাদের জোরালো ‘শটে’ কতবার যে তাঁর ঘুম ভেঙেছে! তবে মায়ের দাবি, এখানেই থামলে চলবে না। এখনও বহু দূর যেতে হবে প্রহ্লাদকে। সংবাদমাধ্যমের কাছে রবিবাবুর আবেদন, ‘‘আপনারাও এমন কিছু করবেন না, যাতে ওর মাথা ঘুরে যায়।’’

মায়ের ইচ্ছে, জাতীয় দলের প্রতিনিধি হিসেবে সবুজ ঘাসে ছেলেকে উড়তে দেখা। দাদার ইচ্ছে, ভাই আই লিগে দাপিয়ে খেলুক। সচিনের যেমন অজিত তেণ্ডুলকর, প্রহ্লাদের জীবনে তেমনি দাদা রবিবাবুর ভূমিকা। সংসার আর ভাইয়ের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দুই-ই সামলেছেন ঠাকুরনগর বাজারে আসবাবপত্রের দোকান চালিয়ে। রবিবাবুর কথায়, ‘‘নিজের রক্ত বিক্রি করে হলেও ভাইকে খেলাব, এই সংকল্প ছিল মনে।’’ সেই দাদাই যে বাবার অভাব টের পেতে দেয়নি, সে কথা প্রহ্লাদও স্বীকার করেন।

অশোকনগর থেকে প্রহ্লাদ যান জামসেদপুরে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ট্রায়াল দিতে। সুযোগ মেলেনি। বেঙ্গালুরুতে ট্রায়াল দিয়েও সুযোগ পাননি। শেষে শিল্টন পালের সহযোগিতায় দুর্গাপুরে মোহনবাগান অ্যাকাডেমিতে যান। এ খান থেকেই সাফল্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। তবে আই লিগে অনূর্ধ্ব ১৯ হিসেবে সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে চাপিয়ে যথেষ্ট ভাল খেললেও সিনিয়র দলে জায়গা হয়নি। এর পরেই তিনি ইস্টবেঙ্গলে চলে আসেন। লাল-হলুদের গোয়ান কোচ কোলাসো এখন ঘষামাজা করছেন তাঁকে। কলকাতা লিগে ৫টি ম্যাচে সুযোগ পেয়ে তিনটি গোল করেছেন ঠাকুরনগরের ছেলে প্রহ্লাদ।

রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া পরিবারটি অবশ্য মাটিতেই পা রেখে চলতে চায়। বাড়িতে আসা সকলকে মিষ্টি মুখ না করিয়ে ছাড়ছেন না কেউ। অনেককে বলতে শোনা গেল কবি বিনয় মজুমদারের পরে ঠাকুরনগর কাউকে পেল, যাকে নিয়ে তাঁরা গর্ব করতে পারেন। ইন্দ্রজিৎ দেবনাথ নামে এক যুবকের কথায়, ‘‘টিভিতে ধারাভাষ্যে যখন বার বার বলছিল ঠাকুরনগরেরে প্রহ্লাদ, রীতিমতো গর্ব হচ্ছিল, জানেন।” চন্দন দেব অন্য এক যুবক বলছিলেন ‘‘প্রহ্লাদ ঠাকুরনগরেরে মুখ উজ্জ্বল করল।’’ স্থানীয় বাসিন্দা তথা গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ধ্যানেশ নারায়ন গুহ এদিন সকালে তার বাড়িতে গিয়ে মায়ের হাতে ফুলের তোড়া এবং মিষ্টি দিয়ে এসেছেন। বনগাঁ মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরী সভাপতি সুব্রত বক্সি বলেন, ‘‘প্রহ্লাদ গোটা মহকুমার মুখ উজ্জ্বল করেছে। ইস্টবেঙ্গলের মতো দলের হয়ে দাপটের সঙ্গে খেলে গোল করছেন, এমন খেলোয়াড় এর আগে মহকুমায় দেখা যায়নি।”

প্রহ্লাদ এখন দমদমের একটি মেসে থাকেন। ছুটি পেলে বাড়ি আসেন। এ দিন সকাল থেকে এলাকার মানুষ তার আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন। দুপুরে তিনি পৌঁছতেই আবেগের বাঁধ ভাঙে সকলের। সাবিত্রীদেবী ছেলেকে বলেন, “ভেবেছিলাম, তুই মঙ্গলবার আরও একটি গোল করবি।’’ মাকে প্রহ্লাদ কথা দেন, আই লিগে সুযোগ পেলে সেই আশা পূরণ করবেন।

সাফল্যে ভেসে না গিয়ে ফুটবলকে জড়িয়েই নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন ঠাকুরনগরের নয়া ‘হার্টথ্রব’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন