ব্রাজিল নিয়ে তীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। ফুটবল মানেই পেলে, ফুটবল মানেই ব্রাজিল শুনে আসছি বল-এ পা দেওয়ার পর থেকেই।
আটের দশকে মারাদোনা-যুগ শুরু হওয়ার পরেও ব্রাজিল নিয়ে নস্ট্যালজিক অনুভূতি ছিল, চোখের পক্ষে আরামপ্রদ ফুটবলের প্রতি টান তখনও কমেনি। কিন্তু এ কোন ব্রাজিল? সেমিফাইনালে ১-৭ চুরমার হওয়ার পর শনিবার রাতে যারা তৃতীয় স্থানের প্লে-অফেও তিন গোল খেল নেদারল্যান্ডসের কাছে। দু’ম্যাচে দশ গোল! অবিশ্বাস্য! তা-ও আবার ঘরের মাঠে।
নেদারল্যান্ডস ম্যাচে দেখলাম দাতে নন-কিকিং ফুট দিয়ে ট্যাকল করছে রবেনদের! বেসিক স্কিলটাই নেই। ভাবা যায়, একজন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের! দ্বিতীয় গোলটা স্কোলারির দল যে ভাবে ডিফেন্সের ভুলে হজম করল, আমাদের এখানে দ্বিতীয় ডিভিসনের খেলাতেও সে রকম বেশি দেখি না।
মোরিনহোকে কোচ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন। যদিও চেলসি ছাড়তে রাজি হননি মোরিনহো। তবে মোরিনহো কেন, পেপ গুয়ার্দিওলা, ক্লিন্সম্যান বা পেকারম্যানের মতো কেউ নেইমারদের কোচ হয়ে এলেও ব্রাজিলকে চার বছর পরেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করা খুব কঠিন। আরও অনেক সময় লাগবে।
কারণ টিমটায় সত্যিকারের ভাল ফুটবলারের অভাব। পেলেদের সময়ের কথা ছেড়ে দিন। সেটা তো ছিল ব্রাজিলের স্বর্ণযুগ। তার পর রোমারিও, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, রিভাল্ডো এমনকী কাকা-ও যা খেলেছে, এই দলে সেই রকম ফুটবলার ক’জন? একটা নেইমার, একটা থিয়াগো সিলভা না থাকলে একটা টিম যদি সাত গোল খায়, তা হলে ধরে নিতে হবে বাকিরা খুবই খারাপ। কেবল কোচ পরিবর্তন করে কী হবে?
স্কোলারিকে তো আমি কেন, কেউই খারাপ কোচ বলতে পারবে না। যে লোকটা ব্রাজিলকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছেন বারো বছর আগে, তাঁকে অসফল বলারও জায়গা নেই। ফলে তাঁর স্ট্র্যাটেজি, ট্যাকটিক্স, দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলারও জায়গা নেই। স্কোলারির এ রকম লজ্জাজনক বিদায় বোধহয় কাম্য ছিল না। তবে টিম হারলে তো খাঁড়া পড়ে কোচের উপরই। তা সে ব্রাজিল হোক বা মোহনবাগান, সব জায়গায় একই ফমুর্লা।
তবে আসল ব্যাপারটা হল, প্রতিভার অভাব এখন ব্রাজিলের ফুটবলে। মোরিনহো বা ক্লিন্সম্যানকেউই তো আর জাদুকর নন যে, রোবট-ফুটবলার তৈরি করবেন। স্কিল, ড্রিবল, পাসিং, গেম মেকিং সবেতেই যে ফিরিয়ে দেবে অন্তত রোনাল্ডোদের যুগ!
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একটা টিম সাত-দশ গোল খেয়ে গেলে সে দেশের ফুটবলকে চট করে আবার টেনে তোলা মুশকিল। সত্তরের এশিয়াডে ব্রোঞ্জ জিতেছিল ভারত। কিন্তু ৭৪-এ তেহরান এশিয়াডে চিনের কাছে সাত গোল খেলাম আমরা। তার পর থেকে কি আর উঠে দাঁড়াতে পারলাম? পারিনি। চিরিচ মিলোভান, স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন, বব হাউটন বিশ্বের কত নামী কোচ তো এলেন আবার চলেও গেলেন। আসলে নিজেদের ভাঁড়ারে প্রতিভা না থাকলে সেটা সম্ভবও নয়। শেষ দু’ম্যাচে দশ গোল খেয়ে হার যে কোনও দেশের ফুটবলকেই অনেকটা পিছিয়ে দেবে।
ব্রাজিলে অসংখ্য ফুটবল অ্যাকাডেমি আছে। যেখান থেকে নেইমার-সিলভারা বেরোয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এখন সেখানেও ঠিকঠাক কাজ হচ্ছে না। ব্রাজিলের লিগও ইপিএল, লা লিগা-র মতো জনপ্রিয় নয়। দেশের সেরা ফুটবলাররা তাই ইউরোপের বড়-বড় ক্লাবে চলে যাচ্ছে। টাকার লোভে।
মোরিনহো বা তাঁর মতো কঠিন পেশাদার মানসিকতার কোনও বিশ্বমানের কোচ পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে এলেও দশ গোল খাওয়া ব্রাজিল রাতারাতি বদলে যাবে বিশ্বাস হচ্ছে না!