ক্যাপ্টেন কুল। এসসিজিতে। বৃহস্পতিবার। ছবি:এএফপি।
টানা সাত ম্যাচ জেতার পর টুর্নামেন্টে প্রথম হার। কিন্তু তার ধাক্কায় বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ার পর ধোনির ভারতের কয়েক জন প্লেয়ারের ড্রেসিংরুমে ঢোকার সময় যে চেহারা দেখা গেল সেটা সত্যি? না গোটা বিশ্বের টিভিতে ম্যাচোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির যে হাসিখুশি মুখটা দেখা গিয়েছে সেটাই আসল?
দেশ-বিদেশ জুড়ে কোটি কোটি ভারতীয় সমর্থকের মতো বৃহস্পতিবার রাতে সিডনিতে ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদেরও মন খারাপ। কয়েক জন নীল জার্সিকে তো এসসিজি ড্রেসিংরুমের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে চোখে জল চিকচিক করতেও দেখা গিয়েছে।
কিন্তু স্বয়ং ধোনি? ক্রিকেট সার্কিটে তাঁর ‘ক্যাপ্টেন কুল’ নামটাকে যেন আরও বেশি দৃঢ়তা দিয়ে ধোনি এক ঘর সাংবাদিকদের মুচকি হেসে বললেন, “ড্রেসিংরুমে আমার প্লেয়ারদের আমি কী বলেছি সেটা না হয় ড্রেসিংরুমের ভেতরেই থাক। তবে মনে রাখবেন কেউ বিশ্বকাপকে নিজের কুক্ষিগত করে রাখে না। আমরা ওটাকে কারও থেকে নিয়েছিলাম চার বছর আগে। চার বছর পরে ওটাকে আমাদের থেকে কেউ নিয়ে যাবে। এ ভাবেই খেলাটা চলে আসছে, চলবে। হ্যাঁ, ফাইনালে উঠতে না পারার জন্য তো খারাপ লাগছেই। তবে কোনও সেমিফাইনাল থেকে তো একটা দলই ফাইনালে উঠবে না কি! আর আমি মনে করি ওরা আজ আমাদের চেয়ে ভাল ক্রিকেট খেলেছে।”
ম্যাচটায় ভারতের জেতার হয়তো সবচেয়ে ভাল সুযোগ থাকত যদি ধোনি টস জিতে আগে ব্যাটিং করতেন। কিন্তু ঠিক উল্টোটাই ঘটায় ধোনি যা নিয়ে বললেন, “ওরা টস জিতে আগে ব্যাটিং নিয়ে যে গতিতে রান তুলছিল মনে হচ্ছিল, পঞ্চাশ ওভারে সাড়ে তিনশোয় পৌঁছবে। কিন্তু আমরা ওদের ৩৩০-এর ভেতর আটকে রাখতে পেরেছিলাম। হ্যাঁ, যদি মিচেল জনসনের ওই ইনিংসটা না ঘটত তা হলে ওদের আমরা তিনশোয় আটকে রাখতাম। তবে এত বড় নক আউট ম্যচে তিনশোও প্রচুর রান।” একটু থেমে তিনি আরও বিশদে ঢুকলেন, “কারণ এটা বড় ম্যাচ। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। ম্যাচের আগে যেখানে যা-ই বলা হয়ে থাকুক না কেন, আমাদের তাড়া করতে হলে ন্যূনতম প্রায় তিনশোই তুলতে হত। আপনাকে ম্যাচের প্রেক্ষিত বুঝে সম্ভাব্য সব কিছুর জন্য পরিকল্পনা ছকে রাখতে হয়। আমাদের যে ব্যাপারটা পক্ষে ছিল যে, আমাদের ব্যাটিং লাইন-আপ জানে তিনশো কী ভাবে সফল তাড়া করতে হয়। কিন্তু আজ আমাদের গেমপ্ল্যানটা সত্যিকারের ভাল যায়নি।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উড়ে এল, কী করে ভাল যাবে? যদি আসল দিন টিমের এক নম্বর ব্যাটসম্যান ১৩ বলে এক রান করে আউট হন? জবাবে ধোনি সেই অচঞ্চল। “বিরাট একটা শট নিয়েছিল কিন্তু আজ সেটা ফল দেয়নি। এটা কোনও কোনও দিন যে কোনও ব্যাটসম্যানেরই হতে পারে। যখন আপনার প্রতিপক্ষ স্কোরবোর্ডে তিনশোর বেশি রান চাপিয়ে দিয়েছে আর তাদের হাতে উঁচু মানের বোলারও আছে, তখন টার্গেটটাকে তাড়া করতে নেমে আপনাকে একটা না একটা সময় ব্যাট হাতে ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকিটা কাজে লাগল তো গোটা ব্যাপারটা ক্লিক করে গেল। কিন্তু কাজে না লাগলে আচমকা সব কিছু পাল্টে যাবে। সেটাই আজ বিরাটের বেলায় হয়েছে। ও একটা শট খেলেছে যেটা ক্লিক করেনি কী করা যাবে।”
বিপর্যস্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ যাওয়ার পর একই মহাদেশে বিশ্বকাপে সাতে সাত করার পর সেমিফাইনাল হারে হয়তো ধোনির এতটা হাসিমুখ! বললেনও তো, “আমরা একটা পরিবারের মতো সবাই মিলে টুর্নামেন্টে কাজ করে গিয়েছি। কারণ, সেটাই আমাদের ঐতিহ্য। যার পিছনে আমি মনে করি, টিমের সাপোর্ট স্টাফেরও প্লেয়ারদের সমানই অবদান আছে। সম্পর্কটা এমন ছিল না যে, তুমি বোলিং কোচ, সেটাই দেখো। তুমি ফিল্ডিং কোচ, ওই দিকটাই সামলাও... বরং গোটা ব্যাপারটা ছিল সবার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ। যেটা গোটা দলকে ভীষণ সাহায্য করে। বিশেষ করে এ রকম চার মাসের একটাই দেশে দীর্ঘ সফরে। আরও কুড়িটা দিন থাকলে আমরা তো অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্বের জন্যও আবেদন করতে পারতাম!” বিশ্বকাপ থেকে বিদায়বেলায়ও স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা ধোনির গলায়!
সব শেষে নিজের আজকের ব্যাটিং আর ক্রিকেটার হিসেবে নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ধোনি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, “আমাদের লোয়ার অর্ডার সত্যি বলতে সে ভাবে ইদানীং কোনও অবদান রাখতে পারেনি। সে জন্য একশোর আশেপাশে চার উইকেট হারানোর পরে আমাদের যদি তখন আরও একটা উইকেট চলে যেত তা হলে ম্যাচের আর কিছু পড়ে থাকত না। সে জন্য বেশি তাড়াতাড়ি আমি হাত খুলতে পারিনি। তা হলে হয়তো আজ ১৪০-১৫০ রানে শেষ হয়ে যেতাম। আর লোকে আমায় প্লেয়ার হিসেবে কী রকম ভাবেন কিংবা আমি কী করতে পেরেছি সেটা নিয়ে কী মত পোষণ করেন, সে সবে আমার কিছু যায়-আসে না। আমি ক্রিকেট খেলার আনন্দে খেলি। সেই আনন্দ এখনও পেয়ে চলেছি। চার বছর পরে আরও একটা বিশ্বকাপ খেলব কি না সেটা নিয়ে পরের বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরে ভাবব। আর যে দিন পুরোপুরি মাঠ ছেড়ে দেব, আমার বাইকগুলো নিয়ে মেতে থাকব।”