একা হাতে ধস-সামাল। ম্যাচ শেষে ধোনি। ছবি: এএফপি।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ভাল কিছু করলেই মিডিয়া থেকে বন্ধুবান্ধব আমাকে একটা প্রশ্ন করে। বলে, এমএস আজ এত করল, ভারতকে আবার জেতাল দিলীপ তুমি ঠিক কতটা গর্ববোধ করছ? তুমিই তো ওকে ক্যাপ্টেন করেছিলে!
মিথ্যে বলব না, গর্ব হয়। আট বছর আগে নির্বাচক প্রধান হিসেবে ছেলেটাকে দায়িত্ব দিয়ে যে ভুল করিনি সেটা ও যখন বারবার প্রমাণ করে, ভাল লাগবে না কেন? দিনের শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা তো এখনও মনের খেলা মানসিক চাপ নেওয়ার ম্যাচ। এমএস ধোনি এখনও যে যুদ্ধটায় নামলে দশ বারের মধ্যে আট বার জিতে বেরোয়। পারফেকশন লেভেলকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, অনায়াসে ম্যাচ ফিনিশের ওপর ক্লাস নিতে পারে ও!
মনে হতে পারে, এত উচ্ছ্বাস কেন দেখাচ্ছি? শুক্রবার আহামরি কী করেছে ও? দরকার ছিল ১৮৩। নিজে ৪৫ নট আউট থেকে ম্যাচটা জিতিয়েছে দেশকে, তাই তো? কিন্তু এর চেয়েও বড় চাপ নিয়ে ধোনি দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছে ওয়াংখেড়েতে। আজকের ইনিংস তা হলে কোথায় এত স্পেশ্যাল?
উদাহরণ দিয়ে বলি। সুরেশ রায়না যখন খোঁচা দিয়ে আউট হল, ভারত ১০৭-৫। ধরে নিচ্ছি, তার দু’একটা বল পরেই ধোনি আউট আর স্কোরটা ১১০-৬। তখন? ক’জন ভারতীয় বুক ঠুকে বলতে পারতেন, ‘ম্যাচটা জিতছিই?’ টার্গেট ১৮৩ আর ভারতের পরপর উইকেট পড়া দেখে অনেকে তো বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন, ওই দেখো তিরাশির ফাইনাল ফিরছে। ভারতের বদলে জিতবে এ বার ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ধোনি সেটা হতে দেয়নি। ৫৬ বলে ওর এ দিনের ৪৫ নট আউট একসঙ্গে বাঁচিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। ভারত ম্যাচটা হেরে গেলে হয়তো গ্রুপ শীর্ষে থাকা নিয়ে ঝামেলায় পড়ত (এখন অবশ্য সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই)। আর তখন কে বলতে পারে, হয়তো কোয়ার্টার ফাইনালে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার মুখেই পড়তে হতো ধোনিদের! তা ছাড়া, এ দিন হারলে টিমের টানা জয়ের অভ্যেসটাই আচমকা ধাক্কা খেয়ে যেত। মনে মনে হয়তো কাজ করত যে, বিশ্বকাপের প্রথম তিনটে ম্যাচ জেতার পর একটা ভাল টিমের বিরুদ্ধে রান তাড়া করতে গিয়ে হেরে গেলাম!
এমএসের ইনিংসের মাহাত্ম্যটা এখানেই।
কোহলি-ধবনদের খেলা দেখতে দেখতে একটা সময় মনে হচ্ছিল, খুব দ্রুতই রানটা তুলে দিতে চাইছে ওরা। বড় বড় শট খেলতে যাচ্ছে। আউটও হচ্ছে। আরে, এখন দু’টো নতুন বল নিয়ে দু’দিক থেকে বোলিং শুরু হয়। প্রথম দশ ওভারে বল মুভ করে। অত ড্রাইভের জায়গাই থাকে না। আমি তো শিউরে উঠছি এটা ভেবে যে, টার্গেটটা আজ ১৮৩-র বদলে আড়াইশো হলে কী হত? ধোনিকেই একমাত্র দেখলাম ইনিংস কী ভাবে এগোবে, তার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখছে। বড় শটের দিকে না গিয়ে চলে যাচ্ছে খুচরো রানে। বাউন্ডারি নয়, নিচ্ছে সিঙ্গলস বা টু’জ। যেটা করলে দু’টো ব্যাপার আপনা-আপনি হতে থাকবে। প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বাড়তে থাকবে। কারণ পার্টনারশিপ হচ্ছে। আর দুই, স্কোরবোর্ডটাও চলতে থাকবে। এগোতে এগোতে এক সময় বিপক্ষ অধিনায়ক আবিষ্কার করবে, ‘যাহ্, আর তো কুড়ি রান বাকি!’
জেসন হোল্ডারের টিমকে ওয়াকায় ঠিক যে অবস্থায় ফেলে ম্যাচটা নিয়ে চলে গেল ধোনি। বললাম না, বড় ব্যাটসম্যান সে-ই, যে মাঠের সঙ্গে মানসিক চাপের ম্যাচটাও সমান দাপটে খেলবে। ধোনিকে দেখলেন এক বারের জন্যও ঝুঁকির রাস্তায় যেতে? বড় ক্রিকেটারের সিগনেচার মার্ক তো এগুলোই। অধিনায়কও তেমন! ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের সময় দেখলাম, ওভারের মাঝপথে রাহানে সিলি পয়েন্টে দাঁড়াতে গিয়ে প্যাড পাচ্ছিল না। ক্লোজ-ইন ফিল্ডারের পা বাঁচানোর বিশেষ প্যাডগুলো তো এমনিতে ড্রেসিংরুমেই রাখা থাকে। পরিবর্ত ক্রিকেটাররা সেগুলো প্রয়োজনমতো মাঠে পৌঁছে দেয়। কিন্তু ওভার চলাকালীন মাঠে পরিবর্ত ক্রিকেটার ঢোকার অনুমতি দেননি আম্পায়াররা। ফলে রাহানেকে ঝুঁকি নিয়ে প্যাড ছাড়াই দাঁড়াতে হচ্ছিল। ধোনি তখন করল কী, নিজের প্যাডটা খুলে দিয়ে দিল! প্যাড না পরেই কিপ করতে শুরু করে দিল। এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই একজন লিডারকে গড়পড়তা ক্যাপ্টেনের চেয়ে আলাদা করে দেয়!
পারথে বহুদিন পর রান তাড়া করতে নেমেছিল ভারত (আমিরশাহি ম্যাচটা ধরছি না)। ওয়াকার গতি আর বাউন্সের সামনে ক্রিস গেইলরা যেমন ঝামেলায় পড়েছে, ভারতীয়রাও পড়েছে। তা ছাড়া আজই প্রথম টিমটাকে দেখে মনে হল, এক জন ব্যাটসম্যান কম হচ্ছে। ধোনির পর আর কেউ থাকছে না, যার ওপর নিশ্চিন্তে ভরসা করা যাবে। যুবরাজ সিংহ থাকলে যে চিন্তাটা থাকত না। ধোনি ছ’জন ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলতে পারত, কারণ যুবরাজ বলটাও করে দেবে। কিন্তু যুবরাজকে পাওয়া যখন যাবে না, তখন মনে হচ্ছে অম্বাতি রায়ডু বা স্টুয়ার্ট বিনির মধ্যে কাউকে আনতে হবে। পরিষ্কার বলছি, লক্ষ্য আজ দু’শোর নীচে ছিল বলে সমস্যায় পড়েও সামলে ওঠা গিয়েছে। কিন্তু এটাই যখন ২৭৫ হবে, তখন কিন্তু বাড়তি এক জন ব্যাটসম্যান না খেললে চাপ মারাত্মক হয়ে যাবে। ভারতকে মনে রাখতে হবে, শুক্রবারের জয়ে ওরা কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গেল। ওখান থেকে কিন্তু সব নক আউট।
যে যুদ্ধে নামার আগে ভারতের দু-একটা দিকে নজর দেওয়া দরকার। যেমন ফিল্ডিং। নক আউট কিন্তু এমন একটা যুদ্ধ, যেখানে একটা হাফ চান্স মিস মানে ম্যাচটাও বেরিয়ে যেতে পারে। ভারতীয় ফিল্ডাররা সেখানে এ দিন গোটা চারেক ক্যাচ ফেলেছে। এক দিন ক্রিকেটে এমন হতেই পারে, কিন্তু টুর্নামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ পর্বে ঢোকার আগে এটা মোটেই সুখের নয়। সবচেয়ে বড় কথা, রোহিত-জাডেজার মতো দুর্দান্ত ফিল্ডাররাও এ দিন ক্যাচ ফেলেছে। নইলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দেড়শোও পেরোত কি না সন্দেহ। বোলিং বরং অনেক স্বস্তিতে রাখবে টিমকে। শেষ দিকে অধিনায়ক হোল্ডারের হাফসেঞ্চুরি বাদ দিলে ভারতীয় বোলাররা আর কাউকে দাঁড়াতেই দেয়নি। শামি-উমেশরা উইকেট টু উইকেট রেখে গিয়েছে। পারথের বাউন্স আর গতিকেও দুর্দান্ত কাজে লাগিয়েছে ওরা। ম্যাচের মাঝে বিশ্রাম পেয়ে যাওয়ায় ওরা আরও ফুটন্ত অবস্থায় নামতে পারছে। এখন দরকার এই নির্মম বোলিংটা টানা করে যাওয়া।
আসলে কোয়ার্টার ফাইনাল এমন একটা যুদ্ধ, যেখানে প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, হাল্কা ভাবে নেওয়ার উপায় থাকবে না। প্রত্যেকটা ওভার, প্রত্যেকটা রান ওই ম্যাচ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হবে। বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং সব কিছুতেই নির্মম হতে হবে। যা অবস্থা, কোয়ার্টারে ভারতের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড বা বাংলাদেশের মধ্যে কেউ একটা হতে পারে। ইংল্যান্ড তো বটেই, বাংলাদেশ পড়লেও কিন্তু হাল্কা ভাবে নেওয়ার জায়গা থাকবে না। ক্রিকেটবিশ্বের আর পাঁচটা শক্তিকে যতটা মর্যাদা দিতে হয়, বাংলাদেশকেও দিতে হবে।
২০০৭-কে আজও কেউ ভুলতে পেরেছে কি?