একটা বছরের শেষ, আর অন্য বছরের শুরুর সময় এমসিজিতে দিনটা চমকের হয়ে থাকল। প্রথমত, মঙ্গলবার সকালে অত দেরি করে স্টিভ স্মিথের ইনিংস ডিক্লেয়ার করা। তার পর সন্ধেবেলা ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির চমকপ্রদ অবসর। অস্ট্রেলীয়রা আরও আগে ডিক্লেয়ার করলে সিরিজটা ৩-০ হত কি না, গত দশ বছরের চেয়ে অস্ট্রেলীয়রা সম্পূর্ণ অন্য রকম খেলল কি না, সন্ধের মধ্যে এ সব তর্ক-বিতর্কই অর্থহীন হয়ে পড়ল।
আপাতত গোটা দেশ ডুবে থাকবে ভারত অধিনায়কের অবসর নিয়ে। ব্যাপারটা নিয়ে লিখতে বসে একদম সত্যি একটা কথা বলছি। সিরিজের মধ্যে এই ঘোষণায় আমি সত্যিই অবাক। তিনটে টেস্ট তো হয়েই গিয়েছিল। আর একটা টেস্ট খেলেই না হয় চাকরিতে ইস্তফা দিত ধোনি। জানি না, সিরিজের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কোনও চোট কি না। যার জন্য হয়তো পরের টেস্টে ধোনি খেলতে পারত না। আঙুলের চোট নিয়েই সিরিজ খেলতে এসেছিল ধোনি। সেই চোটটা আরও বেড়েছে কি না, আমরা কেউ জানি না।
যা-ই হয়ে থাকুক, ধোনি সিডনি টেস্টের পরে অবসর নিলেও আমার মনে হয় নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক। যদিও আমি মনে করি, টেস্ট খেলা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা ঠিক নয়।
আমি আগে এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। তাই বলতে পারি, নেতৃত্ব ছেড়ে দিলে ধোনি অনেক স্বাভাবিক ভাবে খেলতে পারত। টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের ক্ষমতার প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারত। বাকি টেস্ট কেরিয়ারে আমরা তরতাজা এক এমএস ধোনিকে দেখতাম। ওর মধ্যে কিন্তু এখনও ক্রিকেট বেঁচে আছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেতৃত্ব মোটেও সহজ হয় না। আর ধোনি তো এই কাজটা অনেক দিন ধরে করছে। দিনের পর দিন প্রতিটা ফর্ম্যাটে টিমকে নেতৃত্ব দেওয়া খুব কঠিন। তার সঙ্গে কিপিং আর ব্যাটিং যোগ হলে জীবনটা সত্যিই কঠিনতম হয়ে যায়। ও যে এত দিন ধরে এত সব কিছু করে গিয়েছে, সেটা আলাদা করে বলতেই হবে।
সাম্প্রতিক অতীতে ধোনির টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে ক্রিকেটবিশ্বের প্রতিটা কোনায় প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। কেউ যত কাঠিন্যই দেখাক না কেন, ব্যাপারটা সবার উপরই প্রভাব ফেলে। সত্যি বলতে কী, ধোনিকে নিয়ে সমালোচনায় বিশেষ পক্ষপাত ছিল না। ক্যাপ্টেন হিসেবে ধোনির মেয়াদ আমি দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ২০১১-র আগে, আর পরে। ধোনি যত সত্ ক্রিকেটারই হোক না কেন, এটা ওকে মানতেই হবে যে ২০১১-র পরের সময়টা ওর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। বিশেষ করে বিদেশে ১৮টা টেস্টের মধ্যে ১২টা হেরেছে ও। পরিসংখ্যানটা যে কাউকে চূর্ণ করে দিতে পারে। ধোনি যতই ঠান্ডা মাথার হোক, যতই অন্তর্মুখী হোক, এটা ওর উপর প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
এর সঙ্গে ছিল টানা কিপ করে যাওয়ার শারীরিক চাপ, আর সঙ্গে ব্যাটিং। প্রতিযোগী হিসেবে, পারফর্মার হিসেবে, লড়াই ছাড়া হার না মানা মানুষ হিসেবে ধোনি প্রচুর চেষ্টা করে গিয়েছে। কিন্তু ধস আটকাতে পারেনি। তার পর এমন একটা সময় এল যখন নিজের সঙ্গে টিমের বাকি সবাইকে চাঙ্গা করে তোলার মানসিক শক্তিটা ওর আর ছিল না। মনে রাখবেন, ধোনিই কিন্তু এই সমীকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গোটা বিশ্বের অ্যাথলিটদের মধ্যেই এই জিনিসটা খুব দেখা যায়। ব্যাপারটা এমএসডিতেই তাই শেষ হবে না।
তা হলে এ বার এমএসডি কী করবে? কোথায় যাবে? বিশ্বকাপ পর্যন্ত সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের হয়ে খেলবে, ভারতকে নেতৃত্ব দেবে। আর তার পর? বিশ্বকাপের পর প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। উত্তরের জন্যও বোধহয় তত দিন অপেক্ষা করতে হবে।
আগামী কয়েক দিন ধোনির নেতৃত্ব নিয়ে প্রচুর কথা হবে। নিশ্চিত করে বলতে পারি দেশের সেরা ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন ধোনিই। বিশ্বের অন্যতম সেরা। কারণ বিশ্বের অন্য কোনও ক্যাপ্টেনের ক্যাবিনেটে তিনটে বিশ্ব পর্যায়ের খেতাব নেই। অনেকে হয়তো বলবেন, তাঁদের সময় বিশ্ব পর্যায়ের এতগুলো টুর্নামেন্টই হত না। কিন্তু গোটা দেশকেই মানতে হবে ওয়ান ডে নেতৃত্বকে ও একটা আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। আর ওয়ান ডে ব্যাটিংয়ে ও দেশের অন্যতম সেরা।
কিন্তু অনেক রূপকথার মতো একটা বিচ্ছিন্ন তার সব সময়ই থেকে যাবে ওর জীবনে। সেটা হল ধোনি ওর ক্ষমতা দিয়ে বিদেশে টেস্ট ক্রিকেটে আরও অনেক কীর্তি রেখে যেতে পারত। কিন্তু এটাই জীবন। যেখানে একটা আলমারি সব সময়ই খালি পড়ে থাকে।
যাই হোক, এখন গোটা দেশের উঠে দাঁড়িয়ে ঝাড়খণ্ডের চ্যাম্পিয়নকে স্যালুট করার সময়। ওকে বলার সময়, ভারতীয় ক্রিকেটকে তুমি বিরাট উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছ।
ধোনি বনাম সৌরভ
টেস্ট অধিনায়ক
ধোনি ৬০ টেস্ট, ২৭ জয়, ১৮ হার, ১৫ ড্র
বিদেশে ৩০ টেস্ট, ৬ জয়, ১৫ হার, ৯ ড্র
সৌরভ ৪৯ টেস্ট, ২১ জয়, ১৩ হার, ১৫ ড্র
বিদেশে ২৮ টেস্ট, ১১ জয়, ১০ হার, ৭ ড্র