যানজটে জেরবার শহরবাসী। নিজস্ব চিত্র।
গাঁয়ে তাঁকে ক’জন মানে, তা নিয়ে চর্চা আছে দলের অন্দরে। বিধায়ক নিজেও এর আগে জানিয়েছিলেন, দলের অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না তাঁকে। দুই যুব নেতার দাপটে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে আছেন ডায়মন্ড হারবারের বিধায়ক দীপক হালদার। মাঝে তো রীতিমতো বেসুরো হয়ে উঠেছিলেন। দল বদলের হাওয়ায় দীপকও বিজেপির দিকে পা বাড়িয়েছেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। আপাতত দল না বদলালেও দলে তিনি যে কোণঠাসা, তা জানাতে দ্বিধাবোধ করেন না বিধায়ক-ঘনিষ্ঠেরা।
এই পরিবেশের মধ্যেই ফের ভোট আসছে ডায়মন্ড হারবারে। ইতিমধ্যে গত পঞ্চায়েত ভোটে লাগামছাড়া সন্ত্রাসের সাক্ষী থেকেছেন এখানকার মানুষ। বিরোধীদের কী ভাবে মনোনয়নপত্রটুকু জমা দিতে দেওয়া হয়নি, মহকুমাশাসকের অফিসের বাইরে থেকে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে স্মৃতি এখনও এলাকার মানুষের মনে টাটকা। অনুন্নয়নের অভিযোগও বিস্তর।
ডায়মন্ড হারবার বিধানসভা কেন্দ্রে রয়েছে ১৬ ওয়ার্ডের পুরসভা দু’টি ব্লক মিলিয়ে ১৬টি পঞ্চায়েত। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই পুরসভা তাদের দখলে। পঞ্চায়েত এলাকাগুলির কিছু আসন সিপিএমের দখলে থাকলেও ক্রমশ বেশিরভাগ অংশই মিশেছে তৃণমূলে। সব মিলিয়ে ২০১১ সালের পর থেকে ডায়মন্ড হারবারে অধিকাংশই পঞ্চায়েত ও পুরসভা ঘাসফুলের দখলে চলে আসে।
২০১৬ সালে দীপক হালদার দ্বিতীয়বারের জন্য জয়ী হন এই কেন্দ্রে। দলের মধ্যে ভাঙন ধরতে শুরু করে সেই সময় থেকে। যুব ও দলের মূল সংগঠনের মধ্যে শুরু হয় রেষারেষি। এক সময়ে আর হালে পানি পাননি দীপক। তারপর থেকে কপাটহাট মোড়ে দলীয় কার্যালয়ে নিয়ম করে বসে কাজকর্ম করে চলেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই দাপট উধাও তাঁর। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, ‘নখদাঁতহীন বাঘের মতো অবস্থা হয়েছে বিধায়কের।’
এই সুযোগে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে বিজেপির। শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দল আর এলাকার অনুন্নয়নের কথা প্রচারে তুলে এনে ফসল ঘরে তুলছে। গত বিধানসভা ভোটের পর ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে এই এলাকায় অনেকটাই ভোট বাড়িয়ে নিতে পেরেছে তারা। পুরসভার ১৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে প্রায় ১২টিতে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি।
এমনিতেই এলাকার মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি, ডায়মন্ড হারবার শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ, গঙ্গা থেকে পরিস্রুত পানীয় জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পৌঁছনো, শহরের হুগলি নদীর পাড় সাজানো। কিন্তু কোনও কাজই এখনও হল না। নদীর জল বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছলেও তা অপরিস্রুত, লবণাক্ত এবং আবর্জনাযুক্ত বলে অভিযোগ শহরবাসীর। যানজটে জেরবার শহরের মানুষ। পঞ্চাযেত, পুরসভা, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন সরকারি অফিসে শাসকদলের নেতাদের মোটা টাকার টাকা দিয়ে নিয়োগ হচ্ছে বলে অভিযোগ বিরোধীদদের। গ্রামের রাস্তাঘাট পাকা করা হয়নি। ইটও পড়েনি বহু জায়গায়। বিদ্যুৎ পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ আছে। ডায়মন্ড হারবারের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক ঋষি হালদার বলেন, ‘‘আজকের ডায়মন্ড হারবার এই যে চাকরি দেওয়ার নামে তোলাবাজি, দুর্নীতি চলছে, সন্ত্রাস চলছে, সব ক্ষেত্রে শুধু বিধায়ক দায়ী নয়। তৃণমূল দলটাই এ জন্য দায়ী। গত দশ বছর ধরে তৃণমূল ক্ষমতায় রয়েছে। অথচ, কোথাও একটু খাল সংস্কার পর্যন্ত হল না। খাল পাড় দখল করে বড় বড় বাড়ি, দোকান তৈরি হচ্ছে। প্রতি বছর বৃক্ষরোপণ হচ্ছে কোটি কোটি টাকার। সংরক্ষণের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন করে গাছ বসানো হচ্ছে। এই দুর্নীতি চলছেই।’’ বিজেপি নেতা দেবাংশু পণ্ডার অভিযোগ, ‘‘স্বজনপোষণ থেকে শুরু করে নানা প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আমপানে ক্ষতিপূরণের টাকা কী ভাবে ওরা লুটে খেয়েছে, তা সকলেই জানে। প্রশাসনকে জানালেও ব্যবস্থা নেয়নি। গ্রামীণ রাস্তাঘাট এখনও মাটির রয়ে গিয়েছে। দশ বছরেও শহরের মানুষের জন্য পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা হল না। শান্তিপ্রিয় শহরে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের আনাগোনা বেড়েছে এই শাসক দলের মদতে।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ডায়মন্ড হারবার ২ ব্লকের নুরপুর জেটিঘাট এখনও হল না। ভবানীপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো ও পরিষেবা সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছে। অভিযোগের তালিকাটা দীর্ঘ। কিন্তু প্রত্যুত্তর নেই বিধায়কের মুখে। তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’
তা হলে কে নেবে দায়?
যে দুই যুব নেতার দাপটে দীপক কোণঠাসা বলে অভিযোগ, তাঁদের একজন ডায়মন্ড হারবার ১ ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি গৌতম অধিকারী। তিনি বিরোধীদের বক্তব্যকে আমল না দিয়ে জানালেন, প্রতিটি গ্রামে কংক্রিটের রাস্তা, পানীয় জল ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘বিরোধীরা যদি এ সব চোখে না দেখতে পায়, আমার বাইকে করে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়ে আনব।’’ তিনি বলেন, ‘‘ডায়মন্ড হারবারের অধিকাংশ খাল সংস্কার করা হয়েছে। ফুটপাত সুন্দর করে তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে হাইমাস্ট আলো লাগানো হয়েছে। প্রতিটি পঞ্চায়েতে সৌরআলো লাগানো হচ্ছে। ডায়মন্ড হারবারে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল এই জমানায় করা হয়েছে। দু’তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি বাড়িতে পাইপ লাইনের সাহায্যে পানীয় জল পৌঁছে যাবে বলেও জানান তিনি। ডায়মন্ড হারবার ২ ব্লক সামলান ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি মেহেবুবার রহমান গায়েন। তিনি বলেন, ‘‘রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুতের ব্যবস্থা সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছে। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, কৃষি ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভবানীপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জমির সমস্যা আছে। খুব শীঘ্রই স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করে শয্যা চালু করা হবে।’’ নুরপুর জেটিঘাট তৈরির ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে বলে মানছেন তিনি। কিন্তু বিধায়কের বদলে তাঁরাই কী তবে মূল দায়িত্বে? দুই যুব নেতার বক্তব্য, ‘‘বিধায়ক তাঁর নিজের মতো থেকে বিধায়কের মতোই কাজ করেন।’’