ছবি: পরিমল গোস্বামী
(১)
খুদে পড়ুয়াটি নাকি কবিতা লেখে। শুনেই তলব। সারা দুপুর বসে চলল কবিতা লেখা। বিকেলে যিনি ডেকে পাঠিয়েছেন, তাঁর কাছে চলল ছাত্রটি। কবিতা শোনানো হল। কিন্তু প্রতিক্রিয়া মেলে না। বদলে মিলল এক প্লেট পুডিং ও এক প্লেট আনারস। খাওয়া শেষে যিনি ডেকেছিলেন, তাঁকে প্রণাম করল ছাত্রটি। আদর করে খুদেটির চুলে একটু টান মারলেন উনি। উনি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্র-সঙ্গ এখানেই শেষ নয়। কখনও দেখা যায়, সে দিনের শিশুটির যৌবনের একের পর এক রচনা সমালোচনার আঘাতে ‘তছনছ’ করছেন কবি, তা-ও বিদেশি পণ্ডিত মরিস ভিন্টারনিৎস ও ভিক্তর লেসনির সামনে। আবার কখনও দেখা যাবে সেই শিশুর পরবর্তী কালে প্রথম উপন্যাস ‘পদ্মা’ পড়ে আচার্য রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়া দেবেন, ‘আর কিছু দিন পরে তোকে নিয়ে আমরা গৌরব করতে পারবো।’ তা শুনে ছাত্রের জবাব, ‘এখনি গৌরব করতে পারেন, ঠকবেন না।’ না, ঠকেননি রবীন্দ্রনাথ। ঠকেনি বাঙালি। কারণ, সে দিনের সেই শিশুটির নাম প্রমথনাথ বিশী, বাঙালির ‘প্রনাবি।’
(২)
প্রমথনাথের জন্ম, ১১ জুন, ১৯০১। সাবেক পূর্ববঙ্গের রাজশাহির জোয়াড়িতে। প্রমথনাথের বাবা নলিনীনাথ, মা সরোজবাসিনী। নলিনীনাথ অল্প বয়সেই জমিদারির সর্বেসর্বা হলেন। কিন্তু জমিদারি সামলানোর চেয়ে স্বদেশি আন্দোলনেই বেশি স্বচ্ছন্দ নলিনীনাথ। প্রমথনাথের কন্যা চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী জানান, কেল্লার মতো ছিল বিশীদের সাবেক বাড়ি। তা ছেড়ে ১২ বিঘা জমিতে খড়ের বাংলো তৈরি করেন নলিনীনাথ। শোনা যায়, তাঁর জমিদারি যখন নিলামে চড়ছে, তিনি তখন কংগ্রেসি মিটিংয়ে বক্তৃতা দিতে ব্যস্ত।
উত্তরাধিকার সূত্রেই জমিদারির অনুষঙ্গ হিসেবে শরিকি বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা, পুলিশ-আদালত, এ সবের সঙ্গে পরিচিত হলেন প্রমথনাথও। পরে ‘জো়ড়া দীঘির চৌধুরী পরিবার’, ‘চলনবিল’, ‘অশ্বত্থের অভিশাপ’ প্রভৃতি উপন্যাসে এ সব অভিজ্ঞতার ছায়াপাত ঘটবে।
তবে বাবার সঙ্গে সম্পর্কের ধারাপাত নেহাত সহজ নয় প্রমথনাথের।
একটা টুকরো ঘটনা। গল্পটা শুনিয়েছেন চিরশ্রীদেবী। ১৯৩২ সাল, জোয়াড়ি। প্রমথনাথের সঙ্গে নলিনীনাথের কী কারণে যেন খুব ঠোকাঠুকি লেগেছে। তাতে অসন্তুষ্ট বাবা গৃহত্যাগের সংকল্প নিয়ে চললেন নাটোর স্টেশনে। সেখানে গিয়ে তিনি শুনলেন, তাঁর ছেলে এমএ পরীক্ষায় বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। তা-ও প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ও সে কালের বিচারে রেকর্ড নম্বর নিয়ে। বাবার রাগ গলে জল। নাটোরের বিখ্যাত ‘রাঘবসাই’ হাতে বাড়ি ফিরলেন বাবা।
(৩)
এমন স্বাধীনচেতা নলিনীনাথ যে ইংরেজের স্কুলে ছেলেদের ভর্তি করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। ন’বছরের ননী ওরফে প্রমথনাথ ও সাত বছরের প্রফুল্লনাথকে নিয়ে তাই রওনা হলেন তিনি। বোলপুরে ট্রেন থামল। স্টেশনের বাইরে বটগাছের তলায় কয়েকটা গরুর গাড়ি। তাতে চড়েই প্রমথনাথের গুরুগৃহে অবস্থান শুরু, আগামী প্রায় সতেরো বছরের জন্য।
এসেই ক্লাস শুরু গাছতলায়, আমবাগানের মধ্যে, নাট্যঘর লাগোয়া ফটকের তলায়। সঙ্গে শুরু হল দুষ্টুমিও। অঙ্কের ক্লাস। পড়াচ্ছেন জগদানন্দ রায়। বিশী খানিক অমনোযোগী। মুহূর্তে তাঁর কাঁধে পড়ল দু’-এক আলতো থাপ্পড়। তা দেখেই এল চিরকুট, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাতে লেখা, ‘..গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব/ অশ্ব পিটিলে হয় সে গাধা।’ জগদানন্দ চিরকুট দেখিয়ে জানতে চাইলেন, বিশী কোন শ্রেণির? ‘ভারী ধুরন্ধর’ খুদে ছাত্রের জবাব, ‘আমি অশ্ব।’
তবে অঙ্ক-প্রসঙ্গ বিশীর পিছু ছােড়়নি। অঙ্কের পরীক্ষায় একবার লিখলেন কবিতা, ‘হে হরি, হে দয়াময়/ কিছু মার্ক দিয়ো আমায়..’। পরীক্ষক নগেন্দ্রনাথ আইচ খাতা নিয়ে সটান গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তবে রবীন্দ্রনাথ বিশীর পক্ষ নেওয়ায় জল বেশি দূর গড়াল না।
আসলে পরীক্ষার খাতায় কবিতা লেখার মতো বদমায়েশি হোক বা নিয়ম ভাঙা, প্রমথনাথের জুড়ি মেলা ভার। আশ্রম-অনুজ সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় তাই প্রমথনাথ ‘বিদ্রোহী’।
কেমন বিদ্রোহ? সে কালের শান্তিনিকেতনে পড়ুয়াদের কাছে টাকাপয়সা রাখার চল ছিল না। কিন্তু তা বলে ডিম খেতে ইচ্ছে হবে না, এটা ভাবা যায় না। কয়েক জনের ধুতির বিনিময়ে কিশোর প্রমথনাথ সংগ্রহ করলেন চার-পাঁচটি মুরগির ডিম। ক্লাসের ‘কাপ্তেন’-এর নজর এড়িয়ে তা পুঁতে রাখা হল মাঠের মধ্যে গর্ত করে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় হল নুন, লঙ্কা, কেরোসিনের ডিবে, চামচ, তেল প্রভৃতি সরঞ্জাম। অবশেষে শিরীষ গাছের আড়ালে ভাজা হল ডিম। তা মুখে দিয়ে বিদ্রোহের ধ্বজা তুললেন তেরো-চোদ্দোর প্রমথনাথ ও তাঁর সঙ্গীরা।
কিন্তু এ সব বিদ্রোহ কিংবা বদমায়েশির মাঝেই শান্তিনিকেতনের রূপ-রস-গন্ধে জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করল। আলাপ হল কবিতা, প্রবন্ধ, গান, উপন্যাস, নাটক-সহ সাহিত্যের নানা সংরূপের সঙ্গে। অঙ্ক ক্লাসের সেই জগদানন্দবাবুই হলেন বিশীর প্রথম মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ ‘দেয়ালি’র প্রকাশক।
সাহিত্যপ্রীতির সূত্রেই ছেলেবেলায় ‘শিশু’, পরে ‘বুধবার’, ‘শান্তিনিকেতন’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন প্রমথনাথ। সেই সূত্রেই সম্পাদনা ও বিপদ, পাশাপাশি চলে, এ কথা টের পেলেন তিনি।
রেডিয়োর একটি অনুষ্ঠানে। ছবি: পরিমল গোস্বামী
গল্পটা এমন। বন্ধু বিভূতি গুপ্তের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘বুধবার’ একেবারেই বাজারে কাটে না। এক বার পৌষ উৎসবের সময়ে সম্পাদকেরা ঠিক করলেন, এ বার পত্রিকা বিকোতেই হবে। সেই মতো শান্তিনিকেতনে উপাসনার সময়ে যে রবীন্দ্র-গান গাওয়া হত, তা ছাপা হল পত্রিকায়। কলকাতা থেকে আসা ‘সমজদার ক্রেতা’দের কল্যাণে তা বিক্রিও হল ভালই। কিন্তু তাল কাটল উপাসনার সময়ে। দেখা গেল, পত্রিকার ছাপার সঙ্গে কোনও গানই মিলছে না।
মেলেই বা কী ভাবে! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই যে এক রাতের মধ্যে গান বদলে ফেলেছেন। ব্যস, দুই সম্পাদক আর ম্যানেজার যান কোথায়! ততক্ষণে দুই সম্পাদকই অবশ্য নিজ নিজ ঘরে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
(৪)
আসলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশীর সম্পর্কটাই এমন বহুবর্ণ। ‘অচলায়তন’ নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে শান্তিনিকেতনে। তাতে একটি দৃশ্যে ছাত্রেরা দড়ি দিয়ে বাঁধবে আচার্য, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু হোক অভিনয়, তবুও রবীন্দ্রনাথ তো। তাঁকে বাঁধতে পা সরে না ছাত্রদের। এগিয়ে এলেন সেই বিশী। বললেন, ‘দুর ছাই, এ তো অভিনয় বৈ কিছু নয়।’ মঞ্চাভিনয়ে বিশীর সাহস এমনই। এই সাহসে ভর করেই ‘বিসর্জন’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’, ‘বেণীসংহার’, ‘চণ্ড কৌশিক’, ‘দ্য কিং অ্যান্ড দ্য রেবেল’ প্রভৃতি নাটকেও সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করলেন প্রমথনাথ।
শুধু অভিনেতা নন, নাট্য-লেখক ছাত্র এবং গুরুর যোগাযোগও বড়় নিবিড়। প্রসঙ্গ, ‘রথযাত্রা’ নাটিকা। বিশ্বভারতীর কয়েক জন ছাত্র রথের সময়ে গিয়েছেন সুপুর গ্রামে বেড়াতে। দেখা যায়, রথ নড়ছে না। আচমকা বিশীর পরিকল্পনা অনুযায়ী ধানকলের কাজ সেরে ফেরা সাঁওতালেরা হাত দিলেন রথের দড়িতে। গড়াল রথের চাকা। এই ঘটনা নিয়েই বিশী লিখলেন ‘রথযাত্রা’ নাটক। রবীন্দ্রনাথ তা সংশোধন করে বললেন, ‘প্রবাসীতে পাঠিয়ে দে।’ কিন্তু বিশীর এক রা, ‘ওর মধ্যে আমার নিজস্ব কিছু নেই।’ শেষমেশ রবীন্দ্রনাথ নিজেই বিশীর নামে ঋণস্বীকার করে নাটকটি নিজের নামে ছাপালেন।
বঙ্গ নাট্যসাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনে
এ সব নানা ঘটন-অঘটনের শান্তিনিকেতন থেকেই ১৯১৯-এ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ প্রমথনাথের। সেই সময়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তা দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কলেজে কি শেখাবে যা আমরা এখানে শেখাতে পারিনে।’ কবির কাছেই মিলল শেলি, কিটসের কবিতার পাঠ। সে পাঠের মুগ্ধতা এমনই যে, পরে মেয়েকে চিঠিতে প্রমথনাথ লিখবেন, রোমে শেলি, কিটসের সমাধি আছে। সেখানে গেলে যেন ফুল আর তাঁর (প্রমথনাথের) কাব্যগ্রন্থের একটা কপি সমাধিতে রেখে আসা হয়।
(৫)
ক্রমে শান্তিনিকেতন ছাড়ার সময় এল। প্রাইভেটে আইএ পাশ করে ১৯২৭-এ বিদায়ের দিন। প্রিয় বীথিকাগৃহ থেকে বেরোলেন প্রমথনাথ। অদূরেই বটগাছের তলায় বসে জগদানন্দবাবু কী একটা বইয়ের প্রুফ দেখছেন। প্রণাম করতেই মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্ন, ‘কী, চললে? আবার কবে আসছ?’ ‘আমি তো আর আসব না।’ চোখের জল লুকোতেই হয়তো বইয়ের পাতা ছেড়ে বিস্তৃত মাঠের অন্য দিকে তাকিয়ে রইলেন জগদানন্দ। পড়ে রইল শান্তিনিকেতন। তত দিনে অবশ্য ‘বিরাটরাজার গোগৃহ’ পালা লেখা ও অভিনয়ের জন্য শান্তিনিকেতনের কিছু কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়েছেন প্রমথনাথ।
ভর্তি হলেন রাজশাহী সরকারি কলেজে, ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ ক্লাসে। পোশাক-পরিচ্ছদে উদাসীন বইমুখো ছেলেটিই একটা ঘটনায় নাড়িয়ে দিলেন কলেজের ছাত্রসমাজকে। অসহযোগ আন্দোলনের রেশ তখনও চলছে দেশে। এক ছাত্রনেতা ঢুকলেন হস্টেলে। বারান্দায় মেলে রাখা পড়ুয়াদের কিছু ধুতি বিলিতি ভেবে আগুন দিতে শুরু করলেন। দোতলার বারান্দা থেকে চিৎকার করে উঠলেন বিশী, ‘বিলিতি সিগারেট মুখে দিয়ে অন্যের কাপড় পোড়াতে লজ্জা করছে না?’
এখানে ছাত্রাবস্থাতেই ঘটল সাহিত্যিকের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাজশাহির অ্যাডভোকেট সুদর্শন চক্রবর্তীর কন্যা সুরুচিদেবীর সঙ্গে বিয়ে হল। এই সুরুচিদেবীই পরে স্বামীকে এমএ পড়তে আর্থিক সাহায্য করবেন। স্ত্রী সম্পর্কে বিশীর মূল্যায়ন, ‘নিতান্ত কিশোর বয়সে তাহার সমস্ত অলঙ্কার দিয়া আমাদের রক্ষা করিয়াছিল, তাহার ফলে আমি দাঁড়াইবার সুযোগ পাইয়াছি।...এ বাড়ীঘর সমস্তই তাহার পুণ্যে...’ এই দম্পতির দুই কন্যা উজ্জ্বলা, চিরশ্রী এবং দুই পুত্র কনিষ্ক ও মিলিন্দ।
নীহাররঞ্জন রায় ও প্রমথনাথ বিশী
এমএ পরীক্ষায় নজরকাড়া সাফল্যের জন্য বিশী ডাক পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনার। কিন্তু সেই সময়ে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসার কারণে তিনি কলকাতায় ফিরলেন। যোগ দিলেন রামতনু লাহিড়ী গবেষক হিসেবে। গবেষণার ফসল, ‘রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ’। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তা ‘ডক্টরেট’ তকমার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হল না। কিন্তু এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিল না তাঁর। তাঁর বক্তব্য, ‘আমি যা বই লিখেছি, তার ওজন এক মণ হবে। ভারেই কেটে যাবে।’
(৬)
আসলে এমন রসিকতা প্রমথনাথের কর্ম ও ব্যক্তিজীবনে চিরকালের সঙ্গী। ১৯৩৬-এ রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) চাকরির ইন্টারভিউতে ঘটল ফের মজার ঘটনা। সে কালে শান্তিনিকেতনের ফুটবল দলের বিরাট নাম। তাতে প্রমথনাথের অবশ্য ভূমিকা ছিল দলকে ‘চিয়ার আপ’ করার জন্য মাঠের ধার থেকে বাজনা বাজানো। কিন্তু ইন্টারভিউ বোর্ডের ও পারে থাকা বিলেত ফেরত অধ্যাপক তা জানলে তো! তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এক জন টেনিস খেলোয়াড়ের নাম বলুন’। মুহূর্তে বিশীর উত্তর, ‘লর্ড টেনিসন।’ আনন্দে বিশীকে প্রায় জড়িয়ে ধরেন প্রশ্নকর্তা।
বিষয়টা কী? কবি টেনিসনের নাতি, উত্তরাধিকার সূত্রে তিনিও লর্ড টেনিসন। তিনি সেই সময়ে সবে টেনিস খেলতে শুরু করেছেন! এই উত্তরেই কলেজে চাকরি পাকা।
কিন্তু বছরখানেকের বেশি সে চাকরিতে মন টিকল না। যোগ দিলেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদকীয় বিভাগে। এই পত্রিকাতেই তিনি ধারাবাহিক লিখবেন, ‘কমলাকান্তের আসর’। সেখানে কয়েক বছর কাজের পরে অধ্যাপনার ডাক এল। এমন আমন্ত্রণ দিল্লি, যাদবপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ নানা জায়গা থেকে এসেছিল। সবই প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু শেষমেশ এড়াতে পারলেন না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বান। যে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট দেয়নি, সেখানেই তিনি হবেন প্রথম রবীন্দ্র-অধ্যাপক। পরে সামলাবেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা কমিটির সহ-সম্পাদকের দায়িত্বও।
(৭)
কিন্তু মাস্টারমশাই প্রমথনাথ কেমন? প্রায়ই দেখা যায়, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, খাদির ধুতি, পাঞ্জাবি, পায়ে পাম্পশু পরা প্রমথনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন। সঙ্গে হাতঘড়ি বা কলম, কোনওটাই নেই। পরে অবশ্য মেয়ের দেওয়া একটি ঘড়ি তাঁর কব্জিতে শোভা পেত।
এক এক দিন ক্লাসে পড়ুয়াদের ‘যেন আকাশে উড়িয়ে নিতেন তিনি’, অভিজ্ঞতা ছাত্র পবিত্র সরকারের। তবে প্রমথনাথের ক্লাস নিয়ে ভারী মজার অভিজ্ঞতাও রয়েছে পবিত্রবাবুর। ছাত্রাবস্থায় বোলপুর স্টেশনে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে স্বাগত জানান প্রমথনাথ। সেখান থেকেই আজীবন কংগ্রেসপন্থী, গাঁধীভক্ত। প্রমথনাথ তখন রাষ্ট্রপতি মনোনীত রাজ্যসভার সাংসদ। বিস্তর ছোটাছুটি সে সূত্রে। ক্লাসে একটু কম সময় দেওয়া হচ্ছে। এমনই এক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত প্রমথনাথ। সেই সময়ে পবিত্রবাবুরা চেপে ধরলেন, আজ ক্লাস নিতেই হবে।
স্পেশ্যাল পেপার ছোটগল্প আর উপন্যাসের ক্লাস। প্রমথবাবু এসেই জানতে চাইলেন, ছাত্ররা ওয়াল্টার স্কট, ডিকেন্স, টলস্টয়, বালজাক, উগো, রিচার্ডসন প্রমুখের লেখা পড়েছে কি না। উত্তর, ‘না’।
তা শুনে প্রমথবাবু বললেন, ‘কিছুই তো পড়নি তোমরা, তবে আর তোমাদের কী ক্লাস নেব?’
এর পরে ফের এক দিন মাস্টারমশাইকে ক্লাসে টেনে এনেছেন ছাত্ররা। ফের সেই একই প্রশ্ন। তত দিনে পড়ুয়ারা অবশ্য কিছু পড়ে ফেলেছেন। আর তা শুনেই গম্ভীর মুখে প্রমথনাথ বললেন, ‘তোমরা তো সবই পড়েছ দেখছি, তবে আর কী ক্লাস নেব তোমাদের?’ বলেই বেরিয়ে গেলেন রেজিস্টার খাতা হাতে!
তবে এমন মাস্টারমশাইকে এক জন বিপদে ফেলেছিলেন। গল্পটা লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ। ১৯৫৬ সাল। তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘কাব্যবিতান’ নামে কবিতার একটি সংকলন প্রস্তুত করেছেন প্রমথনাথ। আচমকা এক দিন শঙ্খবাবু চিঠি পেলেন। প্রমথনাথ তাতে জানিয়েছেন, তিনি বিপদে পড়েছেন। সাহায্য দরকার। পড়িমরি করে প্রমথনাথের লেক গার্ডেন্সের বা়ড়িতে ছুটলেন শঙ্খবাবু। ‘রোমাঞ্চকর গল্পের ছাঁদে লেখা’ সেই তিন পাতার চিঠিটি পড়ে জানা গেল, তা এক তরুণ কবির লেখা। তাঁর কবিতা অনুমতি ছাড়া সংকলনে কেন ছাপা হয়েছে, তার কৈফিয়ত তলব করেছেন তরুণ কবি। সেই সঙ্গে হুমকি, সদুত্তর না মিললে সংকলকেরা উকিলের চিঠি পাবেন।
শঙ্খবাবু মাস্টারমশাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, উকিলের চিঠিটা নেহাতই মজার ছলে লেখা। কিন্তু প্রমথনাথবাবুর দুর্ভাবনা যায় না। শেষমেশ শঙ্খবাবু সেই তরুণ কবির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁর বক্তব্য, ‘ও আমি একটু মজা করবার জন্যই লিখেছিলাম, আর কিছু নয়।’ কবিটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়! তবে দুর্ভাবনা সত্ত্বেও চিঠি-লেখক সম্পর্কে প্রমথনাথের মূল্যায়ন, ‘লিখবার ক্ষমতা আছে, সেটা বলতেই হবে।’
আসলে মাস্টারমশাই হিসেবে অনুজ সাহিত্যিক অথবা ছাত্রদের প্রতি এমনই দরদ প্রমথনাথের। আর তাই প্রায়ই দেখা যায়, যে সব পড়ুয়াকে তিনি মনে করেন প্রথম শ্রেণি পাওয়ার যোগ্য, তাদের উপুড় হাতে নম্বর দিচ্ছেন। এ বিষয়ে তাঁর একটি যুক্তিও আছে। তা, ‘অন্য পেপারে কম নম্বর পেলে মোটের উপরে পুষিয়ে যাবে।’
শান্তিনিকেতনে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখের সঙ্গে
(৮)
এমন দরদ না থাকলে বোধহয় কৃতী সাহিত্যিকও হওয়াটা সম্ভব নয়। তাই তাঁর কাব্য সংগ্রহে ‘হংসমিথুন’, ‘যুক্তবেণী’, ‘বসন্তসেনা ও অন্যান্য কবিতা’ যেমন রয়েছে, তেমনই নাটকে ‘ঘৃতং পিবেৎ’, ‘ঋণং কৃত্বা’, উপন্যাসে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’, ‘কোপবতী’, ‘পনেরোই আগস্ট’, গল্পগ্রন্থে ‘ব্রহ্মার হাসি’, ‘গল্পের মতো’, ‘অলৌকিক’ প্রভৃতিও রয়েছে। রয়েছে, ‘রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’, ‘বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য’, ‘কমলাকান্তের জল্পনা’, ‘বঙ্কিম সরণী’র মতো গদ্যগ্রন্থ। কিন্তু এত লিখলেন কী ভাবে? এ বিষয়ে চিরশ্রীদেবীর সাক্ষ্য, ফি দিন ভোর থেকে ১০টা পর্যন্ত লিখতেন বাবা। সেই সঙ্গে বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন হয় লিখতেন, নয় পড়তেন। না হয় চুরুট ধরিয়ে এক মনে চিন্তা করতেন। ছাত্র অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যও দেখেছেন, ঘাটশিলায় প্রতি দিন সকালে বারান্দায় মাদুর পেতে বসে লিখছেন মাস্টারমশাই। বিরাট এই সাহিত্যকীর্তির জন্য টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দীর্ঘদিনের সভাপতির পদ, রবীন্দ্র পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ভারত সরকারের পদ্মশ্রী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, আনন্দ পুরস্কার-সহ বহু সম্মানই পেয়েছেন প্রমথনাথ।
বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষা ও ভাষানীতির প্রতিবাদসভায় প্রমথনাথ বিশী। রয়েছেন সুকুমার সেন, প্রতুল গুপ্ত প্রমুখ। ছবি: তপন দাস
(৯)
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সেই বছর। ১৯৮৫। এপ্রিলের শেষ দিক। বাড়িতেই প়়ড়ে গিয়ে কোমরে চোট পেলেন প্রমথনাথ। ভর্তি করানো হল রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানে। ১০ মে বিদায় নিলেন বাঙালির অতিপ্রিয় এক ‘গোটা মানুষ’। ভিড় জমালেন অগুনতি ছাত্র, শিক্ষক, অনুরাগী। বেজে উঠল রবীন্দ্রসঙ্গীত।
কিন্তু মৃত্যুর কিছু কাল আগেও জীবনীশক্তি কেমন ছিল, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পবিত্রবাবু গিয়েছেন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। অসুস্থ প্রমথনাথ এক ডাক্তারের নাম করে বললেন, ‘বুকের ওপর হারমোনিয়াম বাজিয়ে চারশো টাকা নিয়ে চলে গেলেন।’
ঋণ: চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী, পবিত্র সরকার, আনন্দবাজার আর্কাইভ, ‘প্রমথনাথ বিশী’: পম্পা মজুমদার, ‘গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’: সৈয়দ মুজতবা আলী, ‘ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ’: শঙ্খ ঘোষ, ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ ও ‘পুরানো সেই দিনের কথা’: প্রমথনাথ বিশী, ‘কথাসাহিত্য’, ‘কোরক’।