ভারতের চিত্রকলার আধুনিকতায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান অবদান এটাই, তিনি ব্রিটিশ-ঔপনিবেশিক আগ্রাসন থেকে উদ্ধার করে নিজস্ব ঐতিহ্যের শিকড়ে যুক্ত করে আধুনিকতা উন্মীলনের স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করেছিলেন। নন্দলাল বসু সহ তাঁর অন্যান্য শিষ্য পরম্পরার গবেষণার মধ্য দিয়ে সেই পথই প্রসারিত হয়ে গড়ে তুলেছিল এক স্বতন্ত্র ঘরানা, যা আজ নব্য-ভারতীয় ঘরানা নামে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সর্বভারতীয় শিল্প-ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণার রাজনীতিতে অবনীন্দ্রনাথের এই অনন্য অবদান এবং নব্য-ভারতীয় ঘরানার অবস্থান বহু দিন অবহেলিত থেকেছে। এর একটা কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী কালে সাধারণ দর্শক তাঁর ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছেন খুবই কম। তাঁর ছবির একটা বড় অংশ বহু দিন বাক্সবন্দি হয়ে ছিল কলকাতার রবীন্দ্রভারতী সোসাইটিতে। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, কে জি সুব্রহ্মণ্যম, রতন পারিমু প্রমুখ তাত্ত্বিকের মনোজ্ঞ আলোচনা কিছুটা আলো এনেছিল। শিবকুমারের লেখা সহ ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশিত অবনীন্দ্রনাথের সুবৃহৎ সংগ্রহটি প্রকাশের পর শিল্পানুরাগী মানুষ তাঁর ছবির ঐশ্বর্য সম্পর্কে অনেকটাই অবহিত হতে পেরেছেন। এসব সত্ত্বেও মূল ছবি দেখতে না পাওয়ার অভাবটা থেকেই গিয়েছিল।
সেই অভাব কাটিয়ে ওঠার সুযোগ এল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে ভিক্টোরিয়াতে অনুষ্ঠিত অবনীন্দ্রনাথের ১২৩টি ছবির প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। ছবিগুলি এই দুই প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহ থেকে নেওয়া। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা ও ছবি নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পতাত্ত্বিক ও শিল্পী রতন পারিমু।
শিল্পীর আরও ছবি রয়ে গেছে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি, শান্তিনিকেতনের কলাভবন এবং এ ছাড়াও দেশ-বিদেশে বহু ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহে। ভিক্টোরিয়া সংগ্রহের অনেক ছবিই তাঁর আদি-পর্বের কাজ।
১৮৯৭ সালটি অবনীন্দ্রনাথের শিল্পী-জীবনে একটি বিভাজিকা স্বরূপ। তাঁর ছবি আঁকার সূচনা ১৮৮০ সালে মাত্র ন’বছর বয়স থেকে। ১৮৮১ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৮৯২-’৯৫ পর্যন্ত ওলিন্টো গিলার্দি ও চার্লস পামার-এর কাছে পাশ্চাত্য-স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকে ছবি আঁকা শেখেন। ১৮৯১ থেকে ১৮৯৬-’৯৭ পর্যন্ত স্বাভাবিকতার আঙ্গিক নিয়ে চর্চা করেন। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৭-এর মধ্যে স্বাদেশিকতার চেতনার বাতাবরণে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে ঔপনিবেশিকতা-ভিত্তিক আঙ্গিকচর্চার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। আধুনিকতাকে তিনি যুক্ত করতে চান দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে। এরই পরিণতি ১৮৯৭-তে আঁকা তাঁর ‘রাধাকৃষ্ণ চিত্রমালা’। ভারতীয় আধুনিকতার এক নতুন দিগদর্শনের সূচনা হল এখান থেকে। ১৮৯৭ সালেই তাঁর সঙ্গে সংযোগ ঘটে প্রখ্যাত ইংরেজ শিল্পী ও শিল্পতাত্ত্বিক ই বি হ্যাভেলের। এই দুজনের যৌথ প্রয়াসে কলকাতায় নব্য-ভারতীয় ধারার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন বড় মাপের সাহিত্যস্রষ্টা। যদিও সমান্তরাল ভাবে বিকশিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য ও শিল্পকলা, তবু একে অন্যকে প্রভাবিতও করেছে। আখ্যান-নির্ভরতা তাঁর ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। তাঁর ভিতর ছিল যে দরবারি মেজাজ, তা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল মোগল চিত্রশৈলীর দিকে। এর পর ওকাকুরার সান্নিধ্যে এসে জাপানি প্রকরণের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। ১৯০২ সালে তিনি আঁকেন ‘বঙ্গমাতা’। ১৯০৫-এ স্বাদেশিকতার আবহাওয়ায় যা ‘ভারতমাতা’-য় উত্তীর্ণ হয়। ১৯০৬ থেকে ১৯১০-এর মধ্যে করা ‘রুবাইয়াত-ই-ওমরখৈয়াম’ চিত্রমালায় তিনি গড়ে তোলেন একান্ত নিজস্ব আঙ্গিক পদ্ধতি। এর পর নানা ধারায় প্রবাহিত হয় তাঁর ছবি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর নিসর্গচিত্র, মুখোশ-চিত্রমালা এবং ১৯৩০-এর ‘আরব্য-রজনী’ চিত্রমালা।
‘আরব্য-রজনী’-তে তিনি রূপকথা ও পুরাণকল্পের ভিতর দিয়ে কলকাতা তথা বাংলার সমাজবাস্তবতাকে যে ভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাতে থাকে তাঁর অনন্য-সাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয়। ১৯৩৮-এর ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ ও ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ চিত্রমালায় লৌকিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন। প্রদর্শনীতে এ সমস্ত চিত্রমালার নিদর্শন আমরা পাই। শুধু পাওয়া যায় না তাঁর ‘খুদ্দুর যাত্রা’-র অলংকরণ ও ‘কুটুম-কাটামে’র নিদর্শন।