পাহাড়ি সবুজ গ্রাম ধোতরে

ট্রেনে উঠে একঘুমে রাতকাবার। ঘুম ভাঙল পরের দিন সকালে ট্রেনের দুলুনি হঠাৎ থেমে যাওয়ায়। দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়েছে কোনও এক স্টেশনে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম কিসানগঞ্জ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৭ ০২:০৫
Share:

সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে ঢুকেই ঘেমেনেয়ে ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিলাম। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। এখন থেকেই সূর্যে তেজ বাড়ছে তরতরিয়ে। অফিস ফেরত প্রত্যেকদিনের মতো সেদিনও চোখ বুজে সোফায় রিল্যাক্স করছি, এমন সময় কানে এল, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশ্রেণীর অপর নাম স্লিপিং বুদ্ধ অর্থাৎ ঘুমন্ত বুদ্ধ’। চোখ খুলে ঘাড় ঘোরাতেই আমার উত্তর কলকাতার গায়ে গা ঠেকানো বাড়ির জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম পাশের বাড়ির তাতাই তার পড়ার টেবিলে বসে ভূগোল পড়ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা! আঃ! নামটা কানে যেতেই একঝলক টাটকা হিমেল বাতাস শরীরটাকে জুড়িয়ে দিল যেন। ক্লান্তি নিমেষে উধাও। মনের মধ্যে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, মাকালু আর এভারেস্টের স্লাইড শো। টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপ অন করলাম। ইন্টারনেটে সার্চ করতে করতেই গুগলম্যাপ আমায় নিয়ে গিয়ে ফেলল যেখানে সেটা একটা ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ নাম ধোতরে। ব্যস, আর যায় কোথায়। ঘুরতে যাওয়ার মতো জায়গার সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন পায়ের তলায় সর্ষেরা তো সুড়সুড়ি দেবেই। তাই তৎকালে টিকিট কেটে মে মাসের প্রথম শুক্রবারে দার্জিলিং মেলের পেটের ভিতর সেঁধিয়ে গেলাম। সঙ্গী আমার বন্ধু-বেশি-স্বামী-কম মলয়।

Advertisement

ট্রেনে উঠে একঘুমে রাতকাবার। ঘুম ভাঙল পরের দিন সকালে ট্রেনের দুলুনি হঠাৎ থেমে যাওয়ায়। দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়েছে কোনও এক স্টেশনে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম কিসানগঞ্জ। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন সাড়ে ছটা। ২ মিনিট দাঁড়ানোর পর ট্রেন আবার চলতে শুরু করল আর তখন থেকেই বদলে যেতে লাগল বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পরিবেশ। কয়েক মিনিট পর টিপটিপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হল আর সেই বাদলা বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে আমরাও পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি।

গাড়ি আগে থেকেই বুক করা ছিল। ড্রাইভার কমল সাউ মিষ্টি হেসে অভ্যর্থনা জানাল। আমার বর ছবি তুলতে ভালবাসে তাই ড্রাইভারের পাশের সিটটি তার জন্য বরাদ্দ। আমি হাত-পা ছড়িয়ে মাঝখানের সিটে আমার সাম্রাজ্য বিস্তার করলাম। শিলিগুড়ি থেকে মাটিগাড়া হয়ে শিমুলবাড়ি ছাড়াতেই দু’পাশে রোহিণী চা বাগান নিয়ে শুরু হল রোহিণী রোড। পথের দুপাশে নাম-না-জানা অজস্র ফুল, চা বাগান আর পাতার ফাঁকে রোদের লুকোচুরি যেন আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল ‘এখন কয়েকটা দিন সত্যিই হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’।

Advertisement

টানা দু’ঘণ্টা সফরের পর কুয়াশাঘেরা কার্শিয়ঙের হিলকার্ট রোডে পৌঁছে নিলাম ছোট্ট একটা চা-পানের বিরতি। বিরতির পর শুরু হল যাত্রার সেকেন্ড স্পেল। বিভোর হয়ে দেখছিলাম প্রকৃতির রূপ। এমনসময় চটকা ভেঙ্গে গেল ট্রেনের জোরালো হুইসিলে। আরেঃ! আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, চলছে দেখি তিন কামরার রেলের গাড়ি। কু-ঝিকঝিক টয়ট্রেন। যাত্রীরা হাত নাড়লেন। পাকদণ্ডি পথে কিছুদূর যাওয়ার পর খেলনা রেলগাড়ি আমার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কিন্তু থেকে গেল রেললাইন। টুং, সোনাদা হয়ে ঘুম স্টেশন পর্যন্ত সে আমাকে আঁকড়ে রইল। ঘুম থেকে লেপচাজগৎ, সুকিয়াপোখরি, মানেভঞ্জনের মত ছোট ছোট পাহাড়ি শহরের সঙ্গে কিতকিত খেলতে খেলতে সোজা পৌঁছলাম ২৬০০ মিটার, প্রায় ৮৫৩০ ফুট উঁচু ধোত্রেতে। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। বেলা ২টো বেজে গেছে। কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়ায় হাত-পা জমে যাওয়ার উপক্রম। গাড়ি থেকে নামতেই হোমস্টের মিষ্টি পাহাড়ি মালকিন পদ্মা তার আতিথেয়তার উষ্ণতায় আমাদের ভরিয়ে দিল। লাগেজ রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য্যে ভরা ছোট্ট, অনাঘ্রাত একটা গ্রাম যার বাসিন্দা সাকুল্যে ৩০টি পরিবার। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সাজানো প্রতিটি বাড়ির চাল সবুজ রঙের টিন দিয়ে ঢাকা, যার জন্য এই গ্রামের আরেক নাম ‘গ্রিন ভিলেজ’। সব বাড়ির সামনে একচিলতে জমিতে গাজর, বিনস, মটরশুঁটি আলু আর কপির চাষ হচ্ছে। যতদূর চোখ যায় আকাশচুম্বী পাইনগাছের ঘন বনে ঘেরা। পাহাড়ের গায়ে গাঢ় সবুজ ফার্নের ওড়নায় লাল, গোলাপি, হলুদ আর সাদা রঙের ডেইজি, রডোডেনড্রন আর অর্কিডের প্যাচওয়ার্ক। বাতাসে কীসের যেন মৃদু সুবাস জড়ানো। কতরকমের পাখি যে এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে গিয়ে তাদের ব্যস্ততা প্রকাশ করছে তার ইয়ত্তা নেই। পাখিদের কলকাকলি, রাস্তার ধারে ধারে পুঁতে রাখা রঙবেরঙের পতাকার পতপত শব্দ আর ঠাসবুনোট পাইনের বনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার সিম্ফনি নেশায় বুঁদ করে তুলল।

কতক্ষণ এভাবে ছিলাম খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরল মলয়ের ডাকে-‘কি গো, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখবে না? বিকেল পড়ে আসছে কিন্তু।’ সত্যিই তো! যাকে দেখতে এতদূর আসা তাকে তো বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি। দৌড়লাম ভিউ পয়েন্টের দিকে। হোমস্টে থেকে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ। একটা মেডিসিনাল প্ল্যান্টের বাগানের মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে ভিউ পয়েন্টের চূড়োয়। কিন্তু বিধি বাম। দিব্যি রোদঝলমলে পরিবেশ ছিল, হঠাৎ আকাশজুড়ে শুরু হল একদল দামাল মেঘের ঘনঘটা। একেবারে শেষ ধাপে যখন পৌঁছলাম তখন মেঘের আড়ালে সূর্য্যদেব পুরোপুরি মুখ লুকিয়েছেন এবং তার সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘাও। অগত্যা নীচে নামতে হল একরাশ মনখারাপ নিয়ে। হোমস্টেতে ফিরে আসতে গিয়ে দেখি মেঘপুঞ্জ গ্রামের উপর এমন সামিয়ানা টাঙিয়েছে যে দুহাত দুরের মানুষকেও চেনা যাচ্ছে না। তারপরে মুষলধারে বৃষ্টি নামল।

পদ্মা আমাকে আশ্বস্ত করে জানাল পাহাড়ি আবহাওয়ায় রোজই রোদ-বৃষ্টির যুগলবন্দি দেখতে পাওয়া যায়। অতএব সারারাত বৃষ্টি হলে পরের দিন সকালে রোদ উঠবেই। কি আর করি। আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে দুলতে দুলতে নিজেকে কম্বলের নীচে চালান করলাম। ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। আমরা দু’জনে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ডেস্টিনেশন ভিউ পয়েন্ট। চারিদিক অন্ধকার। কিছুই ভাল করে ঠাহর করা যাচ্ছে না। ভিউ পয়েন্টের চূড়ায় পৌঁছে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই ব্রাহ্মমুহূর্তটির জন্য। তাপমাত্রা প্রায় ৬ ডিগ্রির কাছাকাছি। প্রচণ্ড ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি তবু মনের ভিতরে কী অনন্ত উত্তেজনা। ধীরে ধীরে অন্ধকারের পর্দা উঠতে আরম্ভ করল। কাঞ্চনজঙ্ঘার আবছা অবয়ব চোখে ধরা দিচ্ছে। রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। এমন সময় ঊষার প্রথম আলোকরশ্মি চুম্বন করল ঘুমন্ত বুদ্ধের কপালে। তারপর সেই আলো চুঁইয়ে পড়তে লাগল তার সর্বাঙ্গে। শুরু হল কিরীটধারিণী তুষারশৃঙ্গে হলুদ, সোনালি, কমলা, গাঢ় কমলা রঙের শেড চেঞ্জের খেলা। তীব্র নীল আকাশের পটভূমিতে নিঃসীম ধ্যানমগ্নতায় সমাহিত হিমালয় যেন আমাকেও কোন অপার্থিব অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বহুক্ষণ নিস্পলকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ চটক ভাঙল বহু লোকের কিচিরমিচির শুনে। দেখি আশেপাশের হোমস্টেগুলি থেকে চার-পাঁচটি বাঙালি পরিবার ভিউ পয়েন্টে এসেই সেলফি তোলার হিড়িক লাগিয়েছে। আমরা এই হট্টগোল থেকে পালানোর জন্য নীচে নেমে এসে ঠিক করলাম পিকচার পোস্টকার্ডের মতো গ্রামখানা পায়ে হেঁটে দেখব। একটা ছোট শিবমন্দির আর বৌদ্ধ মনাস্ট্রি চোখে পড়ল। অবিরাম ওড়াউড়ি করে চলেছে বিভিন্ন পাখী আর রঙিন প্রজাপতির দল। হাতে উঠে এল বাইনোকুলার। ধোত্রে গ্রামটি সত্যিই পক্ষিপ্রেমীদের স্বর্গ। তবে আমার মতো আনপড় মহিলা দু-দশটা থ্রাশ, সুইফট্, স্কারলেট মিনিভেট আর জাঙ্গল ওয়ার্বলার ছাড়া বেশি কিছুই চিনতে পারল না।

হাঁটতে হাঁটতে দেখি গ্রামের সীমানা শেষ হয়ে বনের সুঁড়িপথ আরম্ভ হয়েছে। সান্দাকফু ট্রেক করতে যাচ্ছে এমন দু’তিনটে দলের সঙ্গে দেখা হল। ওদের কাছে জানলাম এই জায়গাটা ট্রেকার্সদের স্বর্গরাজ্য। পায়ে পায়ে অনেকদূর চলে গিয়েছিলাম। এ বার ফেরার পথ ধরলাম। হোমস্টেতে ফিরে দেখলাম সেখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জটা ভালই দেখতে পাওয়া যায়। চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ অলস ভাবে সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঘমুক্ত নির্মল নীল আকাশের বুকে আদিগন্তবিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি মনের হার্ডডিস্কে চিরদিনের জন্য জমা হয়ে থাকল।

কখন যাবেন

অক্টোবর থেকে মে প্রকৃষ্ট সময়।

কীভাবে যাবেন

দার্জিলিং মেল, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, কাঞ্চনকন্যা, তিস্তা-তোর্সা, উত্তরবঙ্গ বা পদাতিক এক্সপ্রেসে চেপে নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে নামুন। নিউজলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসুন ধোত্রে।

কোথায় থাকবেন

শেরপা লজ, পদ্মা হোমস্টে ছাড়াও আরো দু-তিনটে হোমস্টে আছে।

দোলা মিত্র, কলকাতা-৬

ছুটি এক্সপ্রেস

বেড়ানোর গল্প লিখুন অনধিক ৫০০ শব্দে আর পাঠিয়ে দিন । জানান যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার হালহকিকত। ছবি (নিজেদের ছাড়া) দিন। পাঠান এই ঠিকানায়:

সম্পাদক (‌সেন্ট্রাল বেঙ্গল)

আনন্দবাজার পত্রিকা

৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলিকাতা — ৭০০০০০১

অথবা, করুন ই-মেল:

edit.centralbengal@abp.in

(*সম্পাদকের নির্বাচনই চূড়ান্ত। লেখা ও ছবি ফেরতযোগ্য নয়।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন