চা-বাগান। ফাইল চিত্র।
তাকদা: ইংরেজদের সাধের ক্যান্টনমেন্ট তুকদার সহোদরা আরও এক পাহাড়ি উপনিবেশ। তাকদা। এক ছবি আঁকা পাহাড়ি গ্রাম। আঁকাবাঁকা মসৃণ পথের দু’পাশে জড়িয়ে ধরবে চা-বাগান। ৪,০০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের গায়ে মখমলি চা বাগানের ঢেউ মন ভুলিয়ে দেবে। যত দূর নজর যায় দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির সংসার। সেই চা বাগানের মাঝে মাঝে পাইন আর সিডারের ছায়ামাখা বৃক্ষের দল যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গ্রামজীবনের নানা কোলাজ দেখতে দেখতে চলে আসুন দুর্গামাতা গুহায়। দেখে নিন তাকদার পেমা সোলিং গোম্ফা। মেঘমুক্ত আকাশের সীমানায় স্বমহিমায় কাঞ্চনজঙ্ঘার অফুরান সৌন্দর্যের আর এক নাম, তাকদা।
এক দিকে সিকিমের নামচি, অন্য দিকে জ্বলাপাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু ,পান্ডিমদের হাতছানি। রাত চাঁদনি হলে তাকদা হয় মায়াময়। দূরের পাহাড়ের গায়ে ফুটে ওঠে বিন্দু বিন্দু উজ্জল আভাষ। হিরকদ্যুতির আলোকমালায় আরও মায়াবী হয় তাকদা। ভোরে আপাত নির্জনতা ভেঙে দেয় পাখির কূজন। হিমালয়ের নানা দুর্লভ পাখিদের আসা-যাওয়া, কমলালেবুর বাগান, আসবুজ চা-বাগান আর অর্গানিক ফসলের বাহারে শুধুই মুগ্ধতা। এখান থেকে দার্জিলিং মাত্র ২৮ কিমি। অথচ নির্জন আর কোলাহলমুক্ত। এখানে থাকার জন্য রয়েছে বেশ কিছু হোমস্টে।
কী ভাবে যাবেন: এনজেপি থেকে গাড়িতে চলে আসতে পারেন তাকদা। দূরত্ব ৬০ কিমি।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার জন্য কিছু হোমস্টে রয়েছে। এর মধ্যে গ্লেন ম্যারি হোমস্টে (যোগাযোগ ৯৮৩২৬-৬৭৫৭০) জনপ্রতি ১৫৫০ টাকা, থাকা-খাওয়া সমেত।
গোন্দে কোঠী হোমস্টে (যোগাযোগ ৯৪৭৪৫-৯৪৪৪৬) দু’জনের ডাবল বেড ভাড়া ৩,০০০ টাকা।
রঙ্গারুন চা বাগান: দার্জিলিং যাঁরা বেড়াতে গেছেন জোড়বাংলো চেনেন। এরই কাছে তিন মাইল মোড়। ডান দিকে ঢুকে কিছুটা গেলেই ঘন জনবসতি। এর পর হাল্কা হয়ে আসে জনবসতি। শুরু হয় গহন অরণ্যপথ। জনহীন, নির্জন, পাকদণ্ডী পথ চলে গিয়েছে, সিঞ্চল স্যাংচুয়ারির অন্দরমহলে। সেই জঙ্গলের শেষ হতেই পাহাড়ের গায়ে বাক্স বাড়ি দিয়ে সাজানো রঙিন ফুলের বাহারি পাহাড়ি গ্রাম। আর ঠিক তার নীচেই, বিস্তীর্ণ ঢালে সবুজ নকশা আঁকা চা-বাগান।
উল্টো দিকের নীলচে পাহাড়ের কোলে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দার্জিলিঙের ম্যালের দেখা মিলবে। শুধু কি তাই? জ্বলা পাহাড়, অব্জারভেটরি, টাইগার হিল সমেত গোটা দার্জিলিংকে এখান থেকে অসাধারণ লাগে। দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৬ কিমি দূরের অনাঘ্রাত সৌন্দর্যের নাম ‘রঙ্গারুন চা বাগান’। এখানে বেশ কিছু বাড়িতে গড়ে উঠেছে হোমস্টে। এদের আন্তরিকতা, অতিথি আপ্যায়ন মুগ্ধ করবে। দুটো দিন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারেন এখানে।
রঙ্গারুন চা বাগানের অলিগলিতে
গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চেনা-অচেনা ফুলের বিছানা আর রাসায়নিক সারমুক্ত ফসলের বাহার দেখতে দেখতে স্বছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারেন চা-বাগানের অলিগলিতে। হালকা কুয়াশাকে সঙ্গী করে চলে আসুন রুংদুং খোলার ধারে। শীতে, হিমালয়ের হাজারো পরিযায়ীর দেখা মিলবে। এই বাগানের চা,এক সময় সুদূর বাকিংহাম প্যালেসের অন্দরমহলে সমাদর পেত। জ্যোৎস্নামাখা রাতের রঙ্গারুন যেন মায়াবী স্বপ্নপুরী। হিরের হার জড়ানো গোটা দার্জিলিংকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করুন।
কী ভাবে যাবেন: নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথে তিন মাইল মোড় থেকে ডান দিকে চার কিমি গেলেই রঙ্গারুন চা বাগান।
কোথায় থাকবেন: এখানে থাকার সেরা ঠিকানা ‘খালিং কটেজ’ (৯৮৩২৬-৬৭৫৭০)। থাকাখাওয়া সমেত জনপ্রতি ভাড়া ১,৫৫০টাকা।
সামসিং: অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো। সামসিং-সান্তালেখোলা আর রকি আইল্যান্ড। এক সফরে চা-বাগান, কমলালেবু আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সান্তালেখোলা এবং পাথুরে রকি আইল্যান্ড। নিউ মাল থেকে মেটেলি আসার রাস্তায় শুধুই সবুজের ঢেউখেলানো চা-বাগান। মাঝে মাঝে বনবস্তি। প্রায় ২,৫০০ ফুট উচ্চতায় এলে দেখা মিলবে এক ছবি আঁকা উপত্যকার। সামসিং। সেই নিঝুম উপত্যকার বুক চিরেছে মূর্তি নদী। মূর্তি এখানে ধরা দিয়েছে অন্য চেহারায়। পাইনের বদলে শাল, শিমুলের বিশাল বৃক্ষরাজদের দখলে থাকা সামসিং-এ প্রচুর কমলালেবু গাছ আর নানা পাখির দেখা মেলে।
সুন্দরের ঠিকানা সামসিং
এখানকার চা-বাগান, সহজ সরল গ্রাম্যজীবন, সপ্তাহ শেষের গ্রামীণ হাট, রঙিন ফুলের জলসা আর মরসুমে এলে গাছে গাছে ঝুলে থাকা কমলালেবু। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ সুন্দরের ঠিকানা, সামসিং। সামসিং থেকে সাকাম আর অনবদ্য জঙ্গল ট্রেকে পাহাড়চুড়োর মউচুকি মন ভুলিয়ে দেবে। আপন খেয়ালে বয়ে চলা, এক পাহাড়ি দামাল নদী। আর সেই নদীর পাড় জুড়ে শুধুই কমলার বাহার। সান্তালে-র অর্থ কমলালেবু আর খোলা হল নদী। কমলার বাহার এতটাই যে মূর্তি নদীর বহতার রং বদল করে। হয়ে যায় কমলা। সামসিং থেকে আঁকাবাঁকা প্রায় ৫ কিমি পথ পেরিয়ে চলে এলেই দেখা মিলবে চেকপোস্ট। এখান থেকে প্রায় এক কিমির হাঁটাপথ। চারপাশের পাহাড় আর অরণ্যের সবুজেরা যেন ঝুঁকে পড়ে পলকহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। এক ঝুলন্ত লোহার জাল দিয়ে ঘেরা সেতু।
অরণ্যের সবুজে ঘেরা রকি আইল্যান্ড
নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে সান্তালেখোলা। সেই বেগবান নদীর বহতার শব্দ উপত্যকার সমস্ত নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে যায়। সেতু পেরিয়েই পাথুরে পথের শেষে সুন্দর ৮টি কটেজ। রাতের সান্তালেখোলা দিনের চেয়েও বেশি রোম্যান্টিক। কালচে নীল আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির সমাবেশ, নদীর কলতান, গহন বন থেকে ভেসে আসা বনচরদের গুরুগম্ভীর আওয়াজ— সব মিলিয়ে সান্তালেখোলার আরণ্যক অনুভূতি অসাধারণ। নদী বয়ে চলে তার আপন ঠিকানায়। আর তার সঙ্গে বয়ে আনে নানা নিদর্শন। সামসিং থেকে মাত্র ৪ কিমি দূরে। সবুজ পাহাড় আর তার কোলে, নদীর বুকে বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই যেন সাজিয়ে রাখা রয়েছে। সেই পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলা নদীর চলন। সুন্দর পাথরের বাগানের আর এক নাম রকি আইল্যান্ড।
পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলা নদীর চলন
কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেনে নিউ মাল স্টেশনে নেমে মেটেলি হয়ে সামসিং-এর দূরত্ব ৩৫ কিমি। গাড়িতে চলে আসুন।
সান্তালেখোলা ৫ কিমি, রকি আইল্যান্ড ৪ কিমি।
কোথায় থাকবেন: সামসিং-এ থাকার জন্য রয়েছে সামসিং ফরেস্ট রেস্ট হাউস (৯৪৩৪৩৭৬৩৮৭) ভাড়া ৯০০-১,৫০০ টাকা। অনেক বেসরকারি লজও রয়েছে। তৃষ্ণা লজ (৯৮৩০২-৫২৮৪৩) ভাড়া ৮০০- ১,০০০ টাকা। টেম্পলা ইন (৯৬৭৪৯০০১০১) ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকা।
সান্তালেখোলায় থাকার জন্য রয়েছে সান্তালেখোলা রিভার ক্যাম্প (www.wbfdc.in)
রকি আইল্যান্ডে থাকার জন্য রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প (০৩৫৬১-২৬৪১৭৮২) ভাড়া ১,২০০-১,৫০০ টাকা।
প্রতিটি ক্ষেত্রে ১০% সার্ভিস ট্যাক্স লাগে।
(লেখক পরিচিতি: ক্লাস নাইনে পড়াকালীন পাড়াতুতো মামার সঙ্গে মাত্র ৭০০ টাকা পকেটে নিয়ে সান্দাকফু ট্রেক। সুযোগ পেলেই প্রিয় পাহাড়ে পালিয়ে যাওয়া। বছরে বার কয়েক উত্তরবঙ্গের অল্পচেনা ডেস্টিনেশনে যাওয়া চাই। কুয়াশামাখা খরস্রোতা নদী কিংবা চলমান জীবনছবিতে ক্লিক, ক্লিক। চলতি পথে মেঠো গানের সুর শুনলেই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়া। লাদাখে গর্তে সেঁধিয়ে যাওয়া মারমটের ছবি তুলতে ভিজে মাটিতে সটান শুয়ে অপেক্ষায় থাকা— এই নিয়েই ক্যামেরা আর কলম সঙ্গী করে ২২টা বছর। প্রকৃতির টানে ছুটে বেড়ানোটা থামেনি।)
ছবি: লেখক