Mandarmani

ফের সমুদ্রের টানে

জনশূন্য সৈকত, সমুদ্রের মুখোমুখি এক ভ্রমণপিপাসু। লকডাউনে কেমন ছিল মন্দারমণির রূপ?

Advertisement

অরিত্র সান্যাল

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২০ ০৪:৫৬
Share:

একাকী: সমুদ্রতীরের ঝাউবনে

তখন ভরা লকডাউন। প্রায় চার মাস বাড়িবন্দি থাকার পর একদিন হঠাৎ শুনলাম, ধীরে ধীরে নাকি সব খুলতে শুরু করবে। লকডাউনে মনে হত, বেড়াতে যাওয়া তো আগের জন্মের স্মৃতি! শুক্রবার বিকেলে অফিসের কাজের মাঝে টুক করে একবার ছাদে গিয়ে দেখলাম, বেশ একটা টেকনিকালার সানসেট হচ্ছে। কী রকম যেন মনকেমন করে উঠল। ঠিক করে ফেললাম, রাতেই বেরিয়ে পড়ব কোথাও একটা, আর উইকেন্ডটা কাটিয়েই ফিরব।

Advertisement

সে রাতে ঘুম খুব একটা হল না। ভোর ৪টেয় অ্যালার্ম বাজতেই উঠে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এয়ারপোর্ট, দক্ষিণেশ্বর, বালি ব্রিজ হয়ে ডানকুনি টোল গেট পেরোতেই সব মনখারাপ আর দুশ্চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। সেই চেনা রাস্তা, চেনা হাওয়ার শব্দ, চেনা সব গাড়ির পাশ কাটানোর অঙ্ক কষা আর নিজেকে হারিয়ে ফেলার হাতছানি।

কোলাঘাট পৌঁছলাম ঘণ্টাদেড়েকে। নন্দকুমারের পরের রাস্তা সারিয়ে চওড়া করা হয়েছে। তাই আগের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম মন্দারমণি।

Advertisement

বহুদিন আগে একবার সমুদ্রে গিয়ে সাদা হয়ে নামা বৃষ্টির মাঝে জলে নেমেছিলাম, চারপাশে কেউ ছিল না। মনে হয়েছিল, বিশ্ব চরাচরে আমি একা। অনেকদিন পরে আবার সেই একই অনুভূতি হল। এক শনিবারের সকাল ৯টায় মন্দারমণির ধু-ধু সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে যে সেই দেজাভু হবে, কে জানত! কয়েকজন মাছ ধরতে ব্যস্ত জেলে আর জনাতিনেক আমার মতো বেড়ানো-পাগল লোক ছাড়া গোটা সৈকত জনশূন্য। সমুদ্রের অবিরাম গর্জন, হাওয়া ও পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই কোথাও। সমুদ্র সৈকতে বহুবার এসেছি। ভবিষ্যতেও আসব। কিন্তু মন্দারমণির এই রূপ হয়তো আর কোনওদিন দেখব না।

অতঃপর মাথা গোঁজার জায়গা খোঁজার পালা। বেশির ভাগ রিসর্টই সেই সময়ে বন্ধ। হাতেগোনা কয়েকটি হোটেল টুরিস্টের আশায় দিন গুনছে। তারই একটায় ঢুকে পড়লাম, পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্যানিটাইজ় করে।

সমুদ্রে ঢেউয়ের সঙ্গে প্রিয় যুদ্ধটা সেরে নিয়ে স্নান-খাওয়া করে একটু বিশ্রামের পর বাইক নিয়ে বেরোলাম মোহনার দিকে। পৌঁছে দেখি বালিতে কিছু লাল কাঁকড়া, দুটো কুকুর, কয়েকটা দাঁড়কাক আর আমি ছাড়া কেউ নেই। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র আর তার উপরে এক বিশাল কালো মেঘ, যা সমুদ্রের জল আর দিগন্তে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। সন্ধে পর্যন্ত সেখানেই বসে ঢেউয়ের গর্জন শুনলাম। নিজের সঙ্গে অখণ্ড অবসর কাটানোর এমন সুযোগ আবার কবে পাব, জানি না। পরদিন ভোরে টুক টুক করে হেঁটে গেলাম বিচ ধরে অনেকটা। আগের দিন দেখা সেই জেলেদের সঙ্গে আলাপ হল। শুনলাম, জালে মাছ ধরা পড়ার সংখ্যা বেড়েছে বেশ অনেকটাই, পর্যটক কমে যাওয়ার কারণে। সঙ্গের ঝুড়িগুলিই তার প্রমাণ। এই প্রথম পাফার ফিশ দেখলাম। যে মাছ প্রয়োজনে নিজেদের চেহারা ফুলিয়ে বেলুনের মতো করে ফেলতে পারে। অন্য মাছের সঙ্গে জালে ওঠা পাফার ফিশগুলোকে জেলেরা বালিতেই ফেলে দিচ্ছিল। এই ব্যাঙ মাছকে (জেলেদের ভাষায়) খাওয়া যায় না। বালিতে ফেলে দেওয়ার পর ধরে ধরে সবগুলোকে সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে এলাম। তারপর নিজেকেও ছেড়ে দিলাম সমুদ্রে, এখনকার মতো শেষবারের জন্য।

দিঘা-মন্দারমণি-তাজপুরের সৈকতে এখন ভিড় আবার আগের মতোই। যদিও অনেকে জলে নামছেন না। হোটেলের পুলও খালি রাখা হয়েছে। করোনার দৌলতে গোটা বছরটাই খরচের খাতায়। পাওনার খাতায় যা কিছু জমা করেছি, তার মধ্যে এই জনশূন্য মন্দারমণি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উপরের দিকেই থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন