বৃষ্টি মেখে লালিগুরাসের দেশে

এক পশলা বৃষ্টি এইমাত্র ধুয়ে দিয়ে গেল দু’পাশের পাইন-ফারগুলোকে। জলবিন্দুর আদর পেয়ে পাতারা যেন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। সদ্যস্নাত সুন্দরী গাড়োয়াল যেন গায়ে গাঢ় সবুজরঙা সিফন শাড়ি চাপিয়েছে।

Advertisement

শুভ চক্রবর্তী

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪৩
Share:

ধানোলটি

এক পশলা বৃষ্টি এইমাত্র ধুয়ে দিয়ে গেল দু’পাশের পাইন-ফারগুলোকে। জলবিন্দুর আদর পেয়ে পাতারা যেন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। সদ্যস্নাত সুন্দরী গাড়োয়াল যেন গায়ে গাঢ় সবুজরঙা সিফন শাড়ি চাপিয়েছে। দিল্লির বন্ধু সুমন, অরিজিৎ ও আমি—তিনজনে উৎসবের শরতে পাড়ি জমিয়েছি রডোডেনড্রনের রাজত্বে। গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের বাসে, মুসুরি-চম্বা রোড ধরে চলেছি মুসুরি থেকে ২৪ কিমি দূরে টেহরি গাড়োয়াল জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ধনৌলটি বা ধানোলটির উদ্দেশে। পথে মুসুরি থেকে সঙ্গী হল বৃষ্টি। ‘মেঘ-রোদ্দুর-বৃষ্টি’—এই ত্রিকোণ প্রেমের সাক্ষী হয়ে চলেছি মসৃণ রাস্তা ধরে।

Advertisement

আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এল। আবার শুরু হল উইন্ডস্ক্রিনে ওয়াইপারের ব্যস্ত যাতায়াত। নিত্যনতুন জলরঙে আঁকা ছবি তৈরি হচ্ছে বাসের রেয়ার মিররে। গাড়োয়াল হিমালয়ে মেঘ-পিয়নের আনাগোনা দেখতে দেখতে খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ অরিজিতের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ‘‘ওই দ্যাখ, লাল রডোডেনড্রনের কেমন জেল্লা!’’ যাকে গাড়োয়ালের লোকজন বলেন লালিগুরাস।

এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা দিয়ে গেল মুখে-চোখে।

Advertisement

লালিগুরাস

জানি না কখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। সোনালি রোদে সদ্য-ভেজা গাড়োয়ালের সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ। এখানে রাস্তা বেশ খাড়া। নীল আকাশ ইজেলে ধূসর মেঘ-প্যাস্টেলের হাত বুলোনো দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম উত্তরাখণ্ড রাজ্যের টেহরি গাড়োয়াল জেলার ছোট্ট এই হিল স্টেশন ধনৌলটিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৮৬ মিটার উঁচু এই গ্রামটিতে সাকুল্যে ৫০০ লোকের বসবাস।

বাস এসে থামল ধনৌলটি ইকো পার্কের সামনে। একরাশ মেঘ তাদের ভেজা পালক বুলিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। সঙ্গে আলতো পায়ে হাজির ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে, বৃষ্টি গায়ে মেখে বেড়ানো যে কী ভীষণ রোমান্টিক!

পায়ে পায়ে এসে পৌঁছলাম পার্কের উল্টো দিকে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয়। টেবিলের কাছে এসে দেখি, ধোঁয়া-ওঠা গরম নুডলস হাজির। খেতে খেতে আলাপ হল স্থানীয় যুবক রাজীব রমোলার সঙ্গে। গাড়োয়ালের মানুষদের সহজ সরল জীবনযাত্রা, এখানকার হস্তশিল্প, শাড়ির ওপর বিখ্যাত আরির কাজ প্রভৃতি নিয়ে। অবশেষে রাজীবের কাছে বিদায় নিয়ে ঢুকলাম ধনৌলটির ইকো পার্ক ‘অম্বর’-এ। উত্তরাখণ্ড ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে ১৫ একর জমির ওপর ২০০৮ সালের জুন মাসে গড়ে উঠেছে অ্যালপাইন, চির, দেবদারু, ওক, বার্চ গাছ ঘেরা এই পার্ক। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এগিয়ে এল সঞ্জয় উনিয়াল নামে ধনৌলটি ইকো পার্ক কমিটির এক যুবক। সঞ্জয়ের সঙ্গে একে একে আমরা ঘুরে দেখলাম স্পাইস গার্ডেন, ফ্লাইং ফক্স, বর্মা ব্রিজ।

অম্বর

অবশেষে আমরা চলে এলাম ভিউ পয়েন্টে। মেঘের ঘোমটা জড়িয়ে হিমালয় আজ যেন সলাজ বধূ। নন্দাদেবী, ত্রিশূল, কিছুই দেখতে পেলাম না। বৃষ্টির তোড় আবারও বেড়ে গেছে। সঞ্জয় উনিয়ালকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম বাসে।

ধনৌলটি থেকে চলে এলাম ৬ কিলোমিটার দূরে কাদ্দুখাল নামে এক জায়গায়। এখান থেকে দেড় কিলোমিটার ট্রেক করে আমরা যাব হিন্দু তীর্থ সারকাণ্ডা দেবীর মন্দিরে। পাকদণ্ডি পথ বেয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। জলকাদায় রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশের মুখ ভার। শেষ ৫০০ মিটার পথটা বেশ চড়াই। সিমেন্টে বাঁধানো এই পথ দিয়ে উঠতে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। এত ঠান্ডাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অবশেষে পৌঁছলাম ২৭৫৭ মিটার উঁচুতে সারকাণ্ডা মন্দিরে। উত্তর দিকের আকাশ একটু পরিষ্কার হয়েছে। অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে ‘বান্দারপুঁছ’ শৃঙ্গ। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম প্রতিমা দর্শন করব বলে। এক অদ্ভূত সম্মোহনের ঘোরে তাকিয়ে রইলাম দেবীমূর্তির দিকে। কথিত আছে, দেবী সতীর খণ্ডিত দেহের মাথার অংশটি পড়েছিল এখানে। তার পর থেকেই দেবী এখানে সতী পূজিতা হন ‘মা অম্বা’ নামে। হাজার হাজার বছরের পুরোনো মিথ এসে তীব্র ভাবে নাড়িয়ে দেয়। বুকের ভিতর পর্যন্ত যেন কেঁপে ওঠে আমাদের।

সফরের অবিচ্ছেদ্য অংশ বৃষ্টি আবার এসে সম্মোহন ভাঙাল। এ বার আমাদের ফিরতে হবে মুসুরিতে। পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোয় ফিরে চললাম। পাশের বার্চ গাছ থেকে একটি নাম-না-জানা পাহাড়ি পাখি উড়ে গেল। অরিজিৎ বলল, ‘‘তাড়াতাড়ি চল। সন্ধ্যা নেমে গেলে মুশকিল। এই অঞ্চলটা চিতাদের ডেরা।’’ কিন্তু ওকে কে বোঝাবে আমার একেবারেই যেতে ইচ্ছে করছে না।

কী ভাবে যাবেন —বিমান অথবা ট্রেনে কলকাতা থেকে দেহরাদুন। সেখান থেকে গাড়ি বা ‘জিএমভিএন’-এর বাসে ভায়া মুসৌরি হয়ে ধানোলটি।

কখন যাবেন — বছরের যে কোনও সময়। শীতকালে স্নোফল দেখতে পাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন — ক্রাউন প্লাজা, হোটেল স্নোভিউ, হুইসপারিং পাইন হিমালয়ান রিট্রিট প্রভৃতি বিভিন্ন মান ও দামের হোটেল। রিসর্ট আছে ধানোলটিতে। এ ছাড়া আছে ‘জিএমভিএন’-এর গেস্ট হাউস ধানোলটি হাইটস।

যোগাযোগ—০১৩৭৬-২২৬২২৩,২২৬২২৬।

অনলাইন বুকিংয়ের জন্য লগ অন করুন- gmvn.com -এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন