টলতে টলতে এগোলাম লেকের দিকে

নীচে গোড়ালি ডোবানো কাদা, উপর থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোন দিকে যে পাহাড় আর কোন দিকে যে খাদ বোঝার উপায় নেই। আমরা চলেছি লাচেন। ‘আমরা’ বলতে তিনটি পরিবারের দশ জন।

Advertisement

অঙ্কিতা ঘোষ

বাদকুল্লা, নদিয়া শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০১
Share:

নীচে গোড়ালি ডোবানো কাদা, উপর থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোন দিকে যে পাহাড় আর কোন দিকে যে খাদ বোঝার উপায় নেই। আমরা চলেছি লাচেন। ‘আমরা’ বলতে তিনটি পরিবারের দশ জন। প্রথমে ছাঙ্গু, বাবামন্দির-এর পর লাচেন হয়ে গুরুদম্বা-র লেক। ধস প্রধান রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের কিছুটা ঘুরে যেতে হচ্ছে। উপর থেকে বৃষ্টির জল নেমে আসছে যে-রাস্তায়, সেখান থেকে দু’বার চেষ্টা করেও গাড়ি উঠতে পারল না। পিছন থেকে লাফ দিয়ে নেমে, চাকার নীচে পাথর গুঁজে দিয়ে গাড়ি ঠেকাতে হল। আমরা সবাই নেমে গেলাম। কাদার মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। জুতো মোজা কাদায় মাখামাখি, পিছনে গোঁ গোঁ করে গাড়ি এগিয়ে আসার আওয়াজ। ওই ভাবে গাড়ির হেডলাইটে রাস্তা দেখে দেখে প্রায় আধ কিলোমিটার হাঁটার পর আবার গাড়িতে ওঠা। লাচেনের হোটেলে পৌঁছে গরম ভাত, ডিম, সব্জি, ডাল দিয়ে খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। রাত তিনটের সময় ড্রাইভার দরজায় ধাক্কা দিয়ে তৈরি হতে বলল। ঠিক চারটেতে আমরা গাড়ি ছাড়লাম গুরুদম্বার উদ্দেশে। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলল। লাচেন থেকে গুরুদম্বার ৬২ কিমি রাস্তার পুরোটাই কাঁচা, খানাখন্দে ভরা। কোথাও পিচের চিহ্ন নেই। ফলে গাড়ি চলল হেলতে, দুলতে লাফাতে, লাফাতে। গাড়িতে বসে নিচু ক্লাসে পড়া রবি ঠাকুরের একটা লাইন খুব মনে পড়ছিল, ‘‘দেহের রক্তরস যদি দই হত, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা থেকে প্রাণটা মাখন হয়ে বেরিয়ে আসত!’’ গাড়ির ঝাঁকুনি সামলাতে সামলাতেই ভোরের আলোয় বৃষ্টি-ধোওয়া পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে মন ভাল হয়ে গেল। সবুজ পাহাড়ের গায়ে রঙের খেলা। কিছু গুল্মজাতীয় নাম-না-জানা গাছ হাল্কা হলুদ, আবার কিছু গাছ হাল্কা লাল রঙের সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, কোনও দুষ্টু ছেলে বুঝি সবুজ ইজেলে হলুদ ও লাল রঙে তুলি ডুবিয়ে এক-একটা টান দিয়ে রেখেছে!

Advertisement

দেখতে দেখতেই গুরুদম্বার ১৫ কিলোমিটার আগে সেনা শিবিরে পৌঁছে গেলাম। ড্রাইভার গেল কাগজপত্র জোগাড় করতে। বাইরে টুপটাপ করে বরফ পড়ছে—আকাশ মেঘলা, প্রচণ্ড শীত। আমরা গাড়িতেই বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে ড্রাইভার এসে গাড়ি ছাড়ল। এ বার নতুন পিচের রাস্তা। অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি পিচরাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায় নামল। চারিদিকে ধু-ধু করছে বালি আর ছোট ছোট পাথর। মনে হচ্ছে, মরুভূমি। এখান থেকে লেক অবধি সামান্য চড়াই। আমাদের গাড়ি প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে চলতে শুরু করেও সফল হল না। বাধ্য হয়েই পুরুষেরা নেমে গেল। আর পিছনে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছা়ড়তে এগোতে থাকল গাড়ি। ১৭,৬০০ ফুটতায় গাড়ি থেকে নেমে আমরা দেখি, স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না! মাথা ঘুরছে, পা টলছে। টলতে টলতেই এগোতে থাকলাম। প্রায় এক কিলোমিটার এ ভাবে চলার পর তবে লেকের ধারে পৌঁছলাম। লেকের জল এখান থেকে প্রায় ৫০ ফুট নীচে। জলের কাছে নামার কেউ চেষ্টাও করলাম না। শুধু উপর থেকেই বিধাতার ওই অপূর্ব সৃষ্টিকে উপভোগ করলাম দু’চোখ ভরে।

দূরে দূরে বরফে ঢাকা কালো পাহাড়। এ দিকটায় বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর। নীল রোদ, ঝলমলে আকাশ। তারই মাঝে শান্ত স্নিগ্ধ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই সরোবর। যেন ক্যালেন্ডারের ছবি! কথিত আছে, গুরু নানক এই লেকের জলে পা ডুবিয়ে পাহাড়ের কোলে বসে থাকতেন।

Advertisement

আমাদের বাকি সদস্যেরা গাড়ি থেকে নামার পর কেউ কেউ অসুস্থ বোধ করায় আবার গাড়িতে উঠে পড়লেন। কেউ বা ২-৫ মিনিট ঘুরেটুরে বা ছবি তুলেই ফের গাড়িতে উঠে বসলেন। কারণ এত উঁচুতে বায়ুর চাপ এবং অক্সিজেন দুটোই খুব কম। ফলে বেশিক্ষণ থাকা গেল না। এর পর সেনা শিবিরে ফিরতেই আবার সেই তুষারপাত আর বৃষ্টি শুরু হল।

কী ভাবে যাবেন: নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে গ্যাংটক। গ্যাংটকে অনেক এজেন্সি আছে। যারা থাকা খাওয়া-সহ ঘুরিয়ে আনে। এম. জি. মার্গে সিকিম ট্যুরিজম-এ যোগাযোগ করতে পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন