মেঘের কোলে পাহাড়ের দেশ

আদিবাসী অধ্যুষিত ওড়িশার কান্ধামাল জেলায় ইস্টার্ন ঘাট পাহাড়ের কোলে প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতায় দারিংবাড়ি। আমাদের গাড়ি গোপালপুর ছাড়িয়ে কলকাতা-চেন্নাই রাজপথ ধরে কিছুটা এগিয়ে ব্রহ্মপুর (পুরনো নাম বেরহামপুর)-এর পথ ধরে

Advertisement

সৌমিত্র বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৭ ১৪:২৬
Share:

ছবি: লেখক

আদিবাসী অধ্যুষিত ওড়িশার কান্ধামাল জেলায় ইস্টার্ন ঘাট পাহাড়ের কোলে প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতায় দারিংবাড়ি। আমাদের গাড়ি গোপালপুর ছাড়িয়ে কলকাতা-চেন্নাই রাজপথ ধরে কিছুটা এগিয়ে ব্রহ্মপুর (পুরনো নাম বেরহামপুর)-এর পথ ধরে। বহু পুরনো শহর ব্রহ্মপুর। স্কুল কলেজ কাছারি সরকারি অফিস ব্যাঙ্ক ও অনেক দোকানপাট নিয়ে ব্যস্ত এক জেলা সদর। রাস্তাঘাট বেশ সংকীর্ণ।

Advertisement

শহর ছাড়তে কমে গেল ঘরবাড়ি, যানবাহনের ভিড়। আমাদের সঙ্গী হল ঘন সবুজ ধানের খেত, শরতের আগমনবার্তা বয়ে আনা দোদুল্যমান কাশবন আর দূরে দৃশ্যমান ইস্টার্ন ঘাট পর্বতমালা। বর্ষায় স্ফীত ঋষিকুল্য নদীর সেতুতে আমি ড্রাইভারকে বলি গাড়ি থামাতে। লাল মাটি ধুয়ে আনা নদীর উত্তাল স্রোত, দু’পাশে ঘন কাশবন, আকাশে সাদাকালো মেঘের সঞ্চার—প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

শীঘ্রই গাড়ি সোজা রাস্তা ছেড়ে উঠতে লাগল আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে। রাস্তার দু’ধারে বাঁশঝোপ, সুদীর্ঘ শাল ও সেগুনের জঙ্গল। শুনেছি, সে জঙ্গল ভেঙে প্রায়ই উঠে আসে বুনো হাতির দল। ৭-৮টা ‘হেয়ার পিন’ বাঁক পেরিয়ে আমরা প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর পৌঁছলাম দারিংবাড়ি। চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকার সমতলে ছোট্ট জনপদ দারিংবাড়ি।

Advertisement

শহরের কেন্দ্রে বাসস্ট্যান্ড ও দূর-দূরান্তের গ্রামবাসীর দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর সব উপকরণ নিয়ে এক জমজমাট বাজার। শহরের এক প্রান্তে থাকার জায়গা—আটটি কটেজ নিয়ে ‘ইকো হোমস’। কটেজে বারান্দা থেকে দেখা যায় একটু দূরেই দারিংবাড়ির জনপদ ও পাহাড়। বারান্দায় বসে দেখি, মেঘের ইতিউতি আনাগোনা—ঘন মেঘের দল নেমে আসে পাহাড় পেরিয়ে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘের ঘোমটায় মুখ ঢেকে অদৃশ্য হয় পাহাড়ের সারি।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আকাশের মুখ ভার। মাঝেমাঝেই বৃষ্টি। বৃষ্টি একটু কমতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রায় ৬০ কিমি দূরে ডোকরা শিল্পের জন্য বিখ্যাত আদিবাসীদের গ্রাম বারাখোমা-র উদ্দেশে। দারিংবাড়ি থেকে ফুলবনির রাস্তা ধরে পাহাড় ছাড়িয়ে সমতলে নেমে, পথে পড়ে আধা শহর সিমরানবাড়ি, বেশ ব্যস্ত মহকুমা
শহর বাল্লিগুড়া।

বারাখোমায় তৈরি হয়েছে একটি ‘ডোকরা ক্র্যাফ্ট ডিসপ্লে সেন্টার’। কারিগরেরা ঘুরিয়ে দেখালেন ডোকরা কারখানা, বুঝিয়ে দিলেন নির্মাণ-পদ্ধতির খুঁটিনাটি। কী ভাবে পিতল গলিয়ে তৈরি হয় নানা দেবদেবী ও পশুপাখির মূর্তি, ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে আদিবাসী রমণী, ছই দেওয়া গরুর গাড়িতে বসা চাবুক-হাতে চালক।

ইকো হোমস-এর মধ্যাহ্নভোজন সেরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম দারিংবাড়ির লোকাল সাইট সিইং-এর নেশায়। আমাদের ড্রাইভার নিয়ে যায় পাঙ্গালি ঘাট। সেখানে ঘন জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকার দৃশ্য বড়ই মনোরম। পথে সে গাড়ি দাঁড় করায় ইউক্যালিপ্টাস ও পাইনের জঙ্গলে।

তার পর নিয়ে যায় মশলা ও কফির বাগানে, যেখানে সুদীর্ঘ পাইন গাছ বেয়ে ওঠে থোকা থোকা কালো মরিচের ভারে নুয়ে পড়া লতা— মাটিতে ঘন সবুজ কফি গাছের মেলা। বৃষ্টি একটু কমলে আমরা পৌঁছলাম দারিংবাড়ি প্রশাসন নির্মিত ‘ইকো পার্ক’-এ। শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় চারিদিকে পাহাড়ের অপরূপ শোভা দর্শনের জন্য এক ভিউ পয়েন্ট। ইকো পার্কের ঠিক সামনে ওড়িশা সরকারের বনবিভাগ নির্মিত ‘নেচার পার্ক’।

সেখানে ভেষজ ওষধির এক সুন্দর বাগান, আর বাগানের কেন্দ্রে আযুর্বেদাচার্য চরকের সুদর্শন মূর্তি। পাশেই ‘বাটারফ্লাই পার্ক’—বাগানে বহু ফুলগাছের সমারোহে ফুলের মধু আহরণে রঙবেরঙের প্রজাপতির আনাগোনা।

দূর আকাশে উদাস করা পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের লুকোচুরি, উদ্দাম ঝরনা, সাদাসিধে মানুষের অবাক দৃষ্টি, স্কুলপড়ুয়া বালিকার হাসিমুখ যদি আপনাকে অবাক করে, আনন্দ দেয় তবে একবার নিশ্চয়ই যাবেন দারিংবাড়ি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন