নৈঃশব্দ্যের আখ্যান

মধ্যপ্রদেশের তাওয়া নদীর ব্যাকওয়াটারে মাড়াই-এর আকর্ষণ শুধু ঘন সবুজ জঙ্গল নয়, তার সঙ্গে ঘাপটি মেরে থাকে বাঘ, হরিণ, সম্বর কিংবা বাইসনকাচের জানালায় ভেসে উঠছে আকাশ আর নদীর সিলুয়েট। বালিশে মাথা রেখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। কখন যে চোখ বুজে আসে...

Advertisement

অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

অস্তরাগের আলো: ডেন্ডোয়া নদীতে গোধূলি দর্শন

সে এক অপরূপ জায়গা। সন্ধের পর সাতপুরার শাল, কুসুম, কুম্ভি, মহুয়া বনের মাঝখান থেকে চাঁদ উঁকি দেয়। আলোকিত হয়ে ওঠে তাওয়া নদীর তীর। সারাক্ষণ ঝিঁঝি আর রাতচরা পাখিদের অবিশ্রান্ত ডাকাডাকি। জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়ছে ঘরে।

Advertisement

কাচের জানালায় ভেসে উঠছে আকাশ আর নদীর সিলুয়েট। বালিশে মাথা রেখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। কখন যে চোখ বুজে আসে...

ঘুম থেকে বিছানা ছেড়ে উঠতেই একমুঠো মিষ্টি রোদ। ঘড়িগুলো বাধ্য ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো এই পাহাড় ও নদীকে দু’চোখ ভরে দেখি শুধু। শঙ্কায় হাত ছোঁয়াতে পারি না।

Advertisement

তাওয়া নদীর ব্যাকওয়াটার... জায়গাটার নাম মাধাই। স্থানীয়দের ভাষায় মাড়াই। ভোপাল থেকে সড়কপথে ১৪০ কিলোমিটার। আমরা অবশ্য এসেছি নাগপুর থেকে। দূরত্ব তাই ২৯৩ কিলোমিটার। সাতপুরা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যেই মাড়াইয়ের অবস্থান। বর্তমানে সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক পরিবর্তিত হয়েছে টাইগার রিজ়ার্ভ ফরেস্টে। মাড়াইতেই গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রদেশ টুরিজ়মের নতুন ঠিকানা বাইসন রিসর্ট। ডেন্ডোয়া নদীর তীরে। নদীর অপর দিকেই সাতপুরা টাইগার রিজ়ার্ভের বাফার এবং কোর এরিয়া। সঙ্গে সাতপুরা পাহাড়ের হাতছানি।

মধ্যপ্রদেশ টুরিজ়মের কলকাতা অফিস থেকে আগেই জঙ্গল ভ্রমণের জন্য ফরেস্ট পারমিট করা ছিল। বাইসন রিসর্ট লাগোয়া ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসে সেটি দেখাতেই, গাইড রেডি। তাঁর সঙ্গেই উঠে পড়লাম বন দফতরের লঞ্চে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, জঙ্গল ঘুরব কী করে? গাইড জানালেন, নদীর ও পারে জিপসি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে অবশ্য ছ’জনের বেশি ওঠা যাবে না।

লঞ্চে চেপে জঙ্গল দেখা আর সিনেমায় জঙ্গল দেখা প্রায় একই রকম। বন দফতরের লঞ্চে ডেন্ডোয়া নদী পার করে এসে দাঁড়ালাম সাতপুরা ন্যাশনাল পার্কের দোরগোড়ায়। উঠে পড়লাম গাড়িতে। অরণ্যে এসে অনেক সময়ই জঙ্গল আর দেখা হয় না। ছেলেমানুষের মতো শুধু সেখানকার জন্তু-জানোয়ার দেখার ইচ্ছে জাগে।

পিচঢালা সড়ক ছেড়ে জিপসি ঢুকল আলো-ছায়া মাখা অরণ্যপথে। সে জঙ্গল একেবারে সবুজ। কিন্তু একরঙা নয়, অন্তত বেশ ক’রকম সবুজ তো রয়েছেই! মাঝপথে গাড়ি দাঁড়ালে চুপ করে শুনি জঙ্গলের শব্দ... ক্ষমাহীন সে সব গাছেরা দাঁড়িয়ে থাকে অদ্ভুত নিঃশব্দতা নিয়ে।

গাছের ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকে জিপ চলার রাস্তাকে কী ভীষণ রোম্যান্টিক করে তুলেছে। আসলে প্রকৃতির মতো সিনেম্যাটোগ্রাফার তো আর হয় না! মাড়াইয়ে সাতপুরা জঙ্গলে গাছপালা বলতে মূলত বাঁশঝাড়। সঙ্গে টুকটাক সেগুন, শাল, বহেরা। তবে সব গাছ যে চিনি, তা নয়। মাঝেমধ্যেই রয়েছে বিস্তীর্ণ ঘাসজমি।

গাইডের ডাকে সম্বিৎ ফেরে। সন্তর্পণে ইতিউতি চেয়ে দেখি, বাঘ নাকি! তার মাঝেই চোখে পড়ে, বন থেকে বেরিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে একদল চিতল হরিণ। আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে কালো পাথরের মতো পিঠ নিয়ে একজোড়া ইন্ডিয়ান বাইসন। গাইডের চোখ যেন কী খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রতিটা মুহূর্ত উৎকণ্ঠায়। কী জানি কী হয়... চোখে পড়ল একদল সম্বর। বারো-চোদ্দোটা তো হবেই। গাইড বললেন, ‘ঝুন্ড’।

সময় তখন বিকেল আর গোধূলির পাকদণ্ডীতে আটকে। মাড়াইয়ের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা নীরবতার সুখগুলোকে মনের মণিকোঠায় বাঁধিয়ে রেখে আমরা ফের হলাম ঘরমুখী। জঙ্গল মানে বন্যজন্তুদের সুখের বাসর, নিশ্চিন্ত নীড়। বাঘ না দেখার মাদকতা থাক না বেঁচে পরের বারের জন্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন