নেশার টাকা জোটাতে চলে চুরি-ছিনতাই

ছয়ঘড়িযা পঞ্চায়েত এলাকায় গত কয়েক বছরে অন্তত ৪০ জন যুবকের মৃত্যু হয়েছে হেরোইনের নেশায়। তারপরেও হেরোইনের কারবার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বরং জামতলাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের গ্রামগুলিতেও। পরিস্থিতির খোঁজ নিল আনন্দবাজার। প্রতিবেদক, সীমান্ত মৈত্র।লাল-সাদা চেক শার্ট গায়ে ঘুরঘুর করছিল ক্ষয়াটে চেহারার ছেলেটা। বয়স মেরেকেটে কুড়ি-বাইশ। ইতিউতি চাহনি। দূর থেকে তার হাবভাব দেখে গ্রামের প্রবীণ মানুষটি ফিসফিসিয়ে উঠলেন, ‘‘নতুন খদ্দের এসে গিয়েছে।’’ খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেল ছেলেটি। কেউ তো এল না? বৃদ্ধ গজগজ করতে করতে বললেন, ‘‘টের পেয়েছে কেউ নজর রাখছে। এখানে এল না। একটু দূরে গিয়েই খদ্দেরকে ঠিক খুঁজে নেবে কারবারিরা।’’

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০২:১২
Share:

জামতলার এই সব বাগানে বসে হেরোইনের ঠেক। ছবি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক।

লাল-সাদা চেক শার্ট গায়ে ঘুরঘুর করছিল ক্ষয়াটে চেহারার ছেলেটা। বয়স মেরেকেটে কুড়ি-বাইশ। ইতিউতি চাহনি। দূর থেকে তার হাবভাব দেখে গ্রামের প্রবীণ মানুষটি ফিসফিসিয়ে উঠলেন, ‘‘নতুন খদ্দের এসে গিয়েছে।’’
খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেল ছেলেটি। কেউ তো এল না? বৃদ্ধ গজগজ করতে করতে বললেন, ‘‘টের পেয়েছে কেউ নজর রাখছে। এখানে এল না। একটু দূরে গিয়েই খদ্দেরকে ঠিক খুঁজে নেবে কারবারিরা।’’
জানা গেল, হাতে হাতে চলে যাবে হেরোইনের পুরিয়া। পলিথিনে মোড়া এক একেকটি পুরিয়ার দাম ৬০ টাকা। সিগারেটের রাংতা ভাঁজ করে, তাতে হেরোইন ঢেলে গন্ধ টেনে নেওয়া হয়। তাতেই দেদার নেশা। ইদানীং সিগারেটে পুরেও খাওয়া হচ্ছে হেরোইন। নাম গোপন রাখা হবে, এই শর্তে এক মাদকাসক্ত ভরসা করে বলল, ‘‘এক একেক জনের এক বারে তিন চারটি করেও পুরিয়া লাগে।’’ তবে সকলে নেশায় এত দড় নয়। তাদের দিনে একটি পুরিয়া হলেও চলে। তাতেই সারা দিনের মৌতাত। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নদিয়া এবং কলকাতা থেকেও অনেকে এখানে আসে হেরোইন কিনতে। কিছু তরুণীকেও দেখা যায় কেনাকাটা করতে। মোটর বাইকের পিছনে সওয়ার হয়ে ওড়নায় মুখ ঢেকে হুঁশ করে হেরোইন কিনে নিয়ে চলে যান তাঁরা। গ্রামেরই কিছু যুবক হেরোইনের কারবারে যুক্ত। তাদের হাতে দেদার কাঁচা টাকা।

Advertisement

এ সবই জানা গেল বনগাঁর ছয়ঘড়িয়া পঞ্চায়েত এলাকার কিছু গ্রামে গিয়ে। যার মধ্যে নরহরিপুরে জামতলার নামডাকই শোনা যায় বেশি। বনগাঁ শহর থেকে যশোর রোড ধরে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলের দিকে চার কিলোমিটার এগোলেই ডানদিকে পড়বে জামতলা। বাংলার আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে চেহারা-চরিত্রে তেমন তফাত নেই জামতলার। শুধু তফাত করে দিয়েছে এই এলাকায় দীর্ঘ বছর ধরে চলতে থাকা হেরোইনের রমরমা কারবার। ইদানীং যা আশপাশের এলাকাগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেল।

বাসিন্দারা নিজেদের নাম জানাতে ভয় পান। তবে জানালেন, এখানে সকাল-সন্ধ্যায় অবাধে বিক্রি হয় হেরোইন। বন-জঙ্গল, খেত, বাঁশবাগানে চলে কারবার। কোথাও কোথাও গোল হয়ে বসে মৌতাতও জমে ওঠে। বাসিন্দারা বলেন, হেরোইনে হাট বসে এখানে। প্রায় কুড়ি বছর ধরে চলছে এই পরিস্থিতি।

Advertisement

গ্রামের এক মহিলার কথায়, ‘‘এখানকার বহু পরিবারের ছেলেরা হেরোইনের নেশায় আসক্ত। বাড়িতে তা নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকে। নেশার টাকা জোগাড় করতে ছোটখাট চুরি-ছিনতাইও করে অনেকে। ধরা পড়ে মার খায়। কিন্তু নেশার টান এমনই, ওরা যে ভাবে হোক টাকা জোগাড় করবেই!’’ এক গৃহবধূর কথায়, ‘‘এখানে বহু পরিবারে অশান্তি লেগেই আছে। বাবা-মা, স্ত্রীর কাছ থেকে নেশারুরা জোর করে টাকা ছিনিয়ে নেয়। না দিলেই চলে মারধর।’’ জানা গেল, আশপাশের এলাকার অনেক সম্ভ্রান্ত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেরাও জামতলায় আসে হেরোইনের নেশার টানে।

এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কয়েক বছর আগে পরিস্থিতিটা ছিল আরও ভয়াবহ। স্ত্রী গয়না, জমি বেচেও মরিয়া হয়ে অনেকে নেশার টাকা জোগাড় করত। মাদকাসক্তদের মধ্যে বেশির ভাগেরই আর্থিক অবস্থা নেহাতই শোচনীয়। কেউ ভ্যান চালায়, কারও পেশা দিনমজুরি। সামান্য চাষবাসও করে কেউ কেউ। কিন্তু রোজগারের টাকাটা প্রায় পুরোটাই উড়িয়ে দেয় নেশার পিছনে। একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে নেশা করে। স্থানীয় বাসিন্দারাই উদাহরণ জুগিয়ে দিলেন। জানা গেল, খলিতপুরের মনো মণ্ডল, বিনয় মণ্ডলদের কথা। দুই ভাই নেশাসক্ত ছিলেন। মারা গিয়েছেন। বহু পরিবার সবর্স্বান্ত হয়ে গিয়েছে। নেশার টাকা জোগাড় করতে না পেরে যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করেছে কেউ কেউ। এখনও মাঝে মধ্যে এলাকায় অজ্ঞাতপরিচয় যুবকদের দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশ পরে তা উদ্ধার করে ময়না-তদন্তে পাঠায়। কিন্তু সেই রিপোর্টের অপেক্ষা না করেই এলাকার মানুষ বিলক্ষণ ধরে নেন, নেশা করেই মারা গিয়েছে বহিরাগত ওই ব্যক্তি।

এমনও দেখা যায়, কোনও যুবক অপরিচিত ব্যক্তির কাছে গিয়ে করুণ স্বরে বলছে, ‘‘ওষুধ কিনতে হবে, ক’টা টাকা দেবেন?’’ কিংবা ‘‘সারা দিন খাওয়া হয়নি, কিছু সাহায্য করবেন?’’ এলাকার লোকজন এ সব ছক বিলক্ষণ বোঝেন। কিন্তু অপরিচিত লোকজন অনেকে সহানুভূতি দেখিয়ে টাকা দিয়েও দেন। সেই টাকা নেশায় উড়িয়ে দেয় মাদকাসক্তেরা। এলাকার অনেকে জানালেন, ‘‘নেশাসক্তদের দেখলেই বোঝা যায়। অনেক দিন নেশা করলে ওদের দাঁত-ঠোঁট কালো হয়ে যায়। হাত-পায়ের নখও কালো হয়। একটা সময়ের পরে কুজোঁ হয়ে যায়। ঠিকমতো হাঁটতে-চলতে পারে না।’’

কী ভাবে হেরোইনের কারবার ছড়ায় দুষ্কৃতীরা? এ সব আটকাতে কী পদক্ষেপ করেছে সরকার? গ্রামের মানুষই বা কেন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন না?

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন