স্বামীরা জেলে, ‘ধুর’ পাচারে স্ত্রী-রা

সম্প্রতি এ রাজ্যে ধরা পড়েছে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর তিন সদস্য। তিন জনেই ও পার বাংলার। তদন্তে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ওই জঙ্গিরা উত্তর ২৪ পরগনা সীমান্ত দিয়েই ঢুকেছে। জেলার দুই আন্তর্জাতিক সীমান্ত— বসিরহাট ও বনগাঁয় নিরাপত্তা বাড়লেও দিব্যি চলছে চোরাপথে যাতায়াত। আনন্দবাজারের অন্তর্তদন্তে উঠে এল সেই ছবিই। আজ, বনগাঁ সীমান্ত। উত্তর ২৪ পরগনার দুই আন্তর্জাতিক সীমান্ত বনগাঁ (পেট্রাপোল) ও বসিরহাটের (ঘোজাডাঙা) মাঝখানে গাইঘাটা ব্লক। ও পারে বাংলাদেশের যশোর জেলার পুঁটখালি, ভুলোট।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:০৯
Share:

স্বামীদের কাজ বন্ধ। তাই এগিয়ে এসেছেন স্ত্রী-রা।

Advertisement

চাষাবাদ নয়, হাঁস-মুরগির দেখভাল নয়, ঝুড়ি-কুলো বানানোও নয়। কাজের নাম ‘ধুর’ (সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে মানুষ পারাপার) পাচার!

উত্তর ২৪ পরগনার দুই আন্তর্জাতিক সীমান্ত বনগাঁ (পেট্রাপোল) ও বসিরহাটের (ঘোজাডাঙা) মাঝখানে গাইঘাটা ব্লক। ও পারে বাংলাদেশের যশোর জেলার পুঁটখালি, ভুলোট। বিএসএফের তথ্য বলছে, গাইঘাটার ২২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার মধ্যে ১৪ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া নেই। শীতের শীর্ণ ৫০ মিটার চওড়া ইছামতী পেরোলেই চোরাপথে ও পার থেকে আসা যায় ‘ইন্ডিয়া’য়।

Advertisement

আসছেও। দিনকয়েক আগেই দেখা গেল সেই ছবি। ঠান্ডার রাত। রাস্তার বড় আলো নিভে গিয়েছে। টর্চ হাতে পথ চলছেন এক মহিলা। নদীপাড়ের কাছে থামলেন। টর্চের আলো একবার নদীর দিকে ফেললেন। মুহূর্তে তাঁর কাছে চলে এল কয়েক জন। কোনও কথা নেই। মহিলা গ্রামের পথ ধরলেন। তাঁকে অনুসরণ করল বাকিরা। মিলিয়েও গেল মুহূর্তে।

কারা ওরা?

অত রাতে উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। রাস্তার ধারের একটি বাড়িতে টিমটিমে আলো জ্বলছে। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পরে দরজা একটু ফাঁক করলেন এক মহিলা। প্রশ্নের আগেই তাঁর ঝাঁঝালো প্রশ্ন, ‘‘আপনার কী চাই?’’ পরিচয় দেওয়ার পরে প্রকাশ করলেন বিরক্তির কারণ, ‘‘রাতভর ধুর আসছে-যাচ্ছে। সব সময় চিন্তায় থাকতে হয়।’’ কিছুক্ষণ আগের দৃশ্যের কথা বলতেই মহিলার উত্তর, ‘‘এ আর নতুন কী! এটাই তো হচ্ছে। বাড়ির উঠোন দিয়েও ওরা যাতায়াত করে। টিভিতে কোনও জঙ্গিকে দেখালে মেয়ে বলে ওঠে, এমন একটা লোক আমাদের এখান দিয়ে গিয়েছিল না!’’

বনগাঁ-গাইঘাটা সীমান্ত দিয়ে ‘ধুর’ পাচার নতুন নয়। শুধু বদলেছে ধরনটা। আগে পুরুষরা পাচারের কাজ করত। এখন মহিলারা করে। কিন্তু কেন?

বিএসএফ সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরে হুজি বা লস্কর-ই-তৈবার মতো নানা উগ্রপন্থী সংগঠনের জঙ্গি ধরা পড়ার পরে জানা গিয়েছে, বনগাঁর এইসব সীমান্ত দিয়েই চোরাপথে এ দেশে ঢুকেছে তারা। তার জেরে জোরদার ধরপাকড় শুরু হয়। ‘ধুর’ বা গরু পাচারের অভিযোগে তাদের অনেকেই এখন জেলে।

তাই কি ওই সব অভিযুক্তদের বাড়ির মহিলারা ‘ধুর’ পাচারে নেমেছে? বিএসএফ মানতে চায়নি। তাদের দাবি, কড়া নজরদারিতে চোরাপথে যাতায়াত বন্ধ। কেউ ঢুকে পড়লেও ধরে ফেলা হয়।

কিন্তু গাইঘাটার আংড়াইল ও বর্ণবেড়িয়া মতো সীমান্তবর্তী এলাকার মধ্যে ৫২ পল্লি, আশ্রমবাড়ি দিয়ে এখনও যে চোরাপথে পারাপার চলছে এবং মহিলারাই সে কাজে এগিয়ে এসেছে, এই দাবি গ্রামবাসীদেরই। প্রায় ৩০ বছর ধরে ‘ধুর’ পাচারের পরে ধরা পড়া এক অভিযুক্তের স্ত্রী-ও বলছে, ‘‘এ কাজ ছাড়া করব কী? ধরা পড়ার ঝুঁকি নিয়েও পেটের টানে করতে হয়। নানা জনের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে ধুরপ্রতি ২০০ টাকা থাকে। রাতে গড়ে তিন-চার জনের বেশি ধুর পারাপার করানো যায় না।’’

৫২ পল্লির মতো এলাকায় নদীপথই চোরাপথ। বাঁশঘাটা, গাঙ্গুলিয়া বা সুটিয়ায় আবার কাঁটাতারের ফাঁক গলে ও পাড় থেকে বাংলাদেশিরা আসছে বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা। কয়েক বছর আগে এই বাঁশঘাটা থেকেই ধরা পড়েছিল স্থানীয় বাসিন্দা নুর ইসলাম ওরফে মামা। পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গি নুরই উত্তরপ্রদেশ-সহ একাধিক বিস্ফোরণে যুক্ত। আইএসআইয়ের পাঠানো আরডিএক্স সে-ই পৌঁছে দেয় জঙ্গিদের কাছে। এলাকায় জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক তৈরির দায়িত্বেও ছিল নুর। পাকিস্তানের অনেক জঙ্গিকে চোরাপথে সে এ রাজ্যে ঢুকিয়েছে।

নুরের মতো কেউ কেউ ধরা পড়ায় সীমান্তে কড়াকড়ি বাড়লেও চোরাপথে পারাপার বন্ধ হয়নি বলে জানান বাঁশঘাটার এক যুবক। তাঁর কথায়, ‘‘পাচারকারীরা এখন সতর্ক। ধুরেদের বাড়িতে এসে থাকছে তারা। তার পরে পাঠিয়ে দিচ্ছে কলকাতা বা হাওড়ায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন