কাজি আবদুল গফ্ফর
পঁচানব্বই বছরের মানুষটা স্থির থাকতে পারেননি সে দিন। ঘনিষ্ঠ বৃত্তে বলেছিলেন, ‘‘তোরা করছিসটা কী! ভাই-ভাইয়ে লড়াই বাধিয়েছিস? শান্ত কর বাদুড়িয়া। না পারলে বল, আমি এই শরীর নিয়েই রাস্তায় নামব।’’
গত বছরের কথা। ফেসবুক কাণ্ডের জেরে বাদুড়িয়া এবং সংলগ্ন এলাকায় সে দিন উত্তেজনা চরমে। পুড়ছে অসংখ্য দোকান, বাড়ি। আক্রান্ত অনেকে। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি দেখে মানুষটি সে দিন বলেছিলেন এ কথা। বার্তাটুকু পৌঁছেছিল বাইরেও। ঘটনার উত্পত্তিস্থল বাদুড়িয়া হলেও পরবর্তী সময়ে এই এলাকা তুলনায় ঠান্ডা হয় তাড়াতাড়ি। গোলমালের আঁচ সে বার অনেক বেশি ছড়িয়েছিল বসিরহাট শহরে।
বাদুড়িয়া হারাল এ হেন অভিভাবকটিকে। ছিয়ানব্বই বছর বয়সে চলে গেলেন কংগ্রেস নেতা কাজি আবদুল গফ্ফর। বুধবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ যদুরহাটি দক্ষিণ পঞ্চায়েতের রাজবেড়িয়া গ্রামে নিজের বাড়িতেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাঁর। এরপরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গফ্ফর।
স্ত্রী সাজেদা বিবি, তিন পুত্র, পাঁচ কন্যা ও নাতি-নাতনি-সহ বিশাল পরিবার। অনুরাগীর সংখ্যাও বিপুল। দলমত নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসা পেয়েছেন প্রবীণ মানুষটি। এ দিন এলাকার স্কুল এবং পুরসভায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রয়াত নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী। ছিলেন বিভিন্ন দলের আরও অনেক নেতা-বিধায়ক। শোকবার্তা পাঠান তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার, ইদ্রিশ আলি, বিজেপি নেতা মুকুল রায়।
বাদুড়িয়ার বর্তমান বিধায়ক তথা কংগ্রেস নেতা আব্দুর রহিম দিলু গফ্ফরের ছোট ছেলে। তিনি বলেন, ‘‘বাবা ছিলেন বাদুড়িয়ার মানুষের কাছে একটা মিথ। তাঁকে অনুসরণ করেই আমাদের রাজনীতিতে আসা। শুধু আমরা নয়, অনেকেই তাঁদের অভিভাবককে হারালেন।’’ বাদুড়িয়ার পুরপ্রধান তথা তৃণমূল নেতা তুষার সিংহের কথায়, ‘‘দলমত নির্বিশেষে মানুষকে ভালবাসতেন। এলাকায় অনেক কাজ করেছেন। আদর্শ হিসাবে গফ্ফর সাহেবকে সামনে রেখে অনেকেরই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে।’’
১৯২২ সালে গফ্ফরের জন্ম। ১৯৫০ সালে যদুরহাটি ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হন। ১৯৬৫ সালে আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতি হন। ১৯৬৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আটবার বাদুড়িয়ার বিধায়ক হয়েছিলেন।
বসিরহাট হাইস্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে ১৯৪৬ সালে গফ্ফর ভর্তি হন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে। একটা সময়ে গফ্ফর ছিলেন বিমা সংস্থার আধিকারিক। ফরসা দোহারা চেহারা, কোট-প্যান্ট-টাই, মাথায় টুপি পরা মানুষটাকে সকলে ‘গফ্ফর সাহেব’ বলেই ডাকত সে সময় থেকে। মোটরবাইক নিয়ে এলাকা চষে বেড়াতেন। তবে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর থেকে ধরলেন ধুতি-ফতুয়া। কাঁধে থাকত একখানা গামছা। ওই পোশাকেই ছিলেন বরাবর। ২০০৬ সালে তাঁরই ডাকে বাদুড়িয়ায় এসেছিলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন সভানেত্রী সোনিয়া গাঁধী। একটা সময়ে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ফ্ল্যাটের পাশেই কলকাতার পাম এভিনিউয়ে থাকতেন গফ্ফর। তাঁর সঙ্গে বুদ্ধবাবুর ভাল সুসম্পর্ক ছিল।
এ দিন অধীর বলেন, ‘‘গফ্ফর সাহেব ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠান। অনেকেই তাঁকে ‘গাঁধী’ বলে ডাকতেন। তাঁর কাজ, আদর্শ ভবিষ্যত প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে।’’
আজ, বৃহস্পতিবার বেলা ১০টায় প্রয়াত নেতার দেহ বাড়ির পাশে কবরস্থ করা হবে বলে পরিবার সূত্রের খবর।