প্রথম-পুজো: উচ্ছ্বসিত মাটিয়ার মেয়েরা। নিজস্ব চিত্র
পুজো মণ্ডপে ঢুকলে বরাবর ওঁরে দেখেছেন, লোকে বাঁকা চোখে দেখে। উড়ো মন্তব্য ভেসে আসে। পুরুষরা নজর বুলিয়ে নেয় শরীর জুড়ে। আর মহিলাদের চোখে ভেসে ওঠে ঘেন্না। কেউ স্রেফ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পালিয়ে বাঁচেন।
মাটিয়ার মেয়েরা তাই পুজোয় ব্রাত্য। বাইরের পৃথিবী যখন আলোয় সেজেছে, ঢাকের তালে প্রাণে খুশির নাচ, তখন মাটিয়া ডুবে থাকত পরিচিত আঁধারেই।
এ বারটা অবশ্য আলাদা। মাটিয়ার যৌনপল্লির মেয়েরা নিজেরাই দুর্গাপুজোর উপচার সাজিয়ে নিচ্ছেন। এক লক্ষ টাকা বাজেট। প্রথম বার পুজোর ঢাক শুনবে মাটিয়া। প্রথম বার অষ্টমীর অঞ্জলি দেবেন এখানকার মেয়েরা।
‘‘এ বারে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পাব। নিজেদের ইচ্ছা মতো আনন্দ করব। কেউ এ দিক ও দিক থেকে দ্যাখ দ্যাখ বলবে না’’— কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে বললেন তানিয়া। আরও বললেন, ‘‘এই কারাগারে বন্দি দশা কার ভাল লাগে বলুন। তবুও থাকতে হয়, যাওয়ার তো জায়গা নেই তো!’’ মাত্র বাইশ বছর বয়সেই তাপসীর গলায় হতাশার সুর। তবে পুজোর প্রসঙ্গ উঠতেই বদলে যায় গলা। পুজোয় নতুন শাড়ি কিনেছেন, দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
তাপসীর মতো মাটিয়ায় যৌনপল্লিতে থাকেন প্রায় হাজারজন। কেউ ভালবেসে বিয়ে করে ঠকেছেন। কেউ পেটের দায়ে পেশায় নেমেছেন। কেউ পাচার হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেও বাড়িতে কেউ ঠাঁই দেয়নি। বাড়িতে ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে দেন না স্বামী। ঘুরতে ফিরতে সকলকে কোল বিছিয়ে দিয়েছে মাটিয়ার যৌনপল্লির খুপরি ঘরগুলো।
দুর্বার সমিতির পরিচালনায় মাটিয়ার যৌনপল্লিতে এ বারের পুজোয় মেয়েদের পাশাপাশি সামিল হয়েছেন এলাকার বাড়িওয়ালারাও। সম্পাদক স্বপ্না গাইনের কথায়, ‘‘পুজোর কাজে যাঁরা যুক্ত থাকবেন, তাঁদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ কোষাধ্যক্ষ রণজিৎ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘এখানকার মেয়েরা অন্য পাড়ার পুজো মণ্ডপের ধারকাছ ঘেঁষতে পারেন না। এমনকী, তাঁদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও ব্রাত্য করে রাখে বাইরের সমাজ। তাই ওঁদের সকলের আনন্দের কথা ভেবে পুজোর আয়োজন।’’
মোনালিসা, কল্পনা, রত্না, ভ্রমর, তাঞ্জিলারা জানালেন, নিজের হাতে করে পুজোর কাজের সুযোগ পাবেন, ভেবে আনন্দ আর উত্তেজনায় দিন কাটাচ্ছেন।
যেখানে মায়ের মূর্তি গড়তে তাঁদের দুয়ারের মাটির প্রয়োজন, সেখানে তাঁরাই পুজো মণ্ডপে গেলে বিদ্রুপ জোটে। রেশমা বলেন, ‘‘নাচের অনুষ্ঠানে গিয়ে যখন মহিষাসুরমর্দিনী পালায় দুর্গা সাজি, তখন কত মানুষ হাততালি দেন। অথচ, যদি বলি বছরের অন্য সময়ে যৌনপল্লিতে কাজ করি, মুখের চেহারাগুলো বদলে যায়। আমরা যে পরিস্থিতির শিকার, সে কথা কেউ বোঝে না।’’
পুজোর কয়েকটা দিন নিজেদের পরিস্থিতি বদলাতে এ বার এককাট্টা মাটিয়ার মেয়েরা।