বেশি রোজগারে ঝুঁকি তো থাকবেই

বনগাঁ মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এক সবের পরেও বহু শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছেন।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৪৬
Share:

কানাই ও অর্জুন

ভিনরাজ্যে একের পর এক বাঙালি শ্রমিকের খুন, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে সংসদেও শোরগোল ফেলেছেন তৃণমূল সাংসদেরা। ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের ফিরে আসার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, সে ক্ষেত্রে এককালীন অর্থ সাহায্য করা হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

Advertisement

কিন্তু এ সবের পরেও শ্রমিকেরা কতজন ফিরবেন, আদৌ ফিরবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ, এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে বহু মানুষ স্রেফ বেশি টাকা রোজগারের আশায় ভিটেমাটি ছেড়ে ভিনরাজ্যে, এমনকী ভিনদেশেও পাড়ি জমান। অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়তে হয়। বিদেশ-বিভুঁইয়ে আটকে পড়েন। প্রাণহানিও ঘটে। এই সূত্রেই রাজস্থানের মাটিতে মালদহের আফরাজুল শেখের হত্যা বা ও আলিপুরদুয়ারের মধু সরকারের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠে আসে।

বনগাঁ মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এক সবের পরেও বহু শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছেন। কারও ছেলেরা ভিন রাজ্যে মারধর খেয়েও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সেখানেই টিঁকে গিয়েছেন। ভিন রাজ্যে খেতমজুরি, রাজমিস্ত্রির কাজে যাওয়া কয়েকজন শ্রমিক টেলিফোনে জানালেন, বাংলায় কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। বনগাঁর প্রত্যন্ত গ্রামে খেতমজুরি করলে দিনের শেষে ১৫০-২০০ টাকা মেলে। আর ভিন রাজ্যে দিনে মেলে ৫০০-৬০০ টাকা। এককালীন মোটা টাকা ঘরে তুলতে অনেকেই অন্য রাজ্যে যান। বছরের যে সময়ে চাষবাসের কাজ থাকে না, সেই কয়েক মাস বাড়তি রোজগারের আশাতেও অনেকে গ্রাম ছাড়েন। আবার কয়েক মাস রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কেরলে কাজ করে ফিরে এসে হাল চষায় মন দেন।

Advertisement

কথা হচ্ছিল বনগাঁর মাধবপুরের বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর কানাই বিশ্বাসের সঙ্গে। বললেন, ‘‘সামনের সপ্তাহেই অন্ধ্রপ্রদেশে সেন্টারিংয়ের কাজে যাচ্ছি। এখানে এখন কাজ নেই। এলাকায় যখন থাকি, তখন খেতমজুরি করে দিনে ২০০ টাকার বেশি মেলে না। অন্ধ্রপ্রদেশে সেন্টারিংয়ের কাজ করে দিনে মেলে ৩০০ টাকা। সঙ্গে ওভার টাইম করেও বাড়তি রোজগার হয়।’’ কানাইবাবু গত পাঁচ বছর ধরে ভিন রাজ্যে কাজে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অন্ধ্রপ্রদেশে তিন মাস থেকে কাজ করলে খাওয়া-থাকার খরচ বাদ দিয়েও হাজার পঁচিশ টাকা ঘরে নিয়ে ফেরা যায়।’’

এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে নারাজ তিনি। ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে কোনও সমস্যার মধ্যেও পড়তে হয়নি কখনও, জানালেন কানাইবাবু। এক সঙ্গে আড়াইশো জন বাঙালি শ্রমিক কাজ করেন সে রাজ্যে। একে অন্যের বিপদে-আপদে পাশে থাকেন। কিন্তু অনেকের তো মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। কানাইবাবুর যুক্তি, ‘‘বেশি রোজগার করতে হলে একটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে।’’

মণিগ্রাম মৎস্যজীবীপাড়ার বাসিন্দা অর্জুন রায় সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই ফিরেছেন। খেতে ধান রোয়ার কাজ করতেন। একমাস কাজ করে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সে রাজ্যে ৬০০ টাকা রোজ মেলে, জানান অর্জুন। এখানের রোজগার থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি। মৎস্যজীবী পাড়ার অনেক যুবকই প্রতি বছর দল বেঁধে অন্ধপ্রদেশে যান। এখনও বহু যুবক সেখানেই কর্মরত। তাঁদেরই একজন চৈতন্য মণ্ডল। তাঁর স্ত্রী অনুমতি মণ্ডল বলেন, ‘‘স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত ফোনে কথা হয়। আমাদের কোনও ভয় নেই। স্বামী নিরাপদেই আছেন।’’

ধর্মপুকরিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান সন্তোষ রায় বলেন, ‘‘আমাদের এখান থেকে বহু যুবক ভিন রাজ্যে কাজে যান। বাড়তি টাকা আয়ই উদ্দেশ্য। অনেকে এ ভাবে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছলও হয়েছেন। পাকা বাড়ি করেছেন কেউ কেউ।’’ বাগদা ব্লকের মামভাগিনা নেতাজিপল্লির বাসিন্দা নির্মল মণ্ডলের দুই ছেলে মিঠুন ও নীতিশ তামিলনাড়ুতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। নির্মলবাবু জানালেন, সম্প্রতি ওখানে আমার ছেলেদের স্থানীয় লোক মারধর করেছে। পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। পুলিশ ছেলেদের বলেছেস কাজের এলাকা ছেড়ে বাইরে না বেরোতে।’’ আতঙ্কে আছে গোটা পরিবার। দুই বৌমার খাওয়া-ঘুম উড়েছে। এরপরেও কেন ছেলেদের চলে আসতে বলছেন না?

নির্মলবাবু বললেন, ‘‘পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। এখানে কাজ নেই। নিজস্ব জমিও নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন