শুরু হয়ে গেল কালোবাজারি, দিশাহারা বাজার

কয়েক ঘণ্টার নোটিসে বাতিল হয়ে গিয়েছে ৫০০ ও ১০০০ টাকার সব নোট। সেই সিদ্ধান্ত ভাল না খারাপ, সেটা ভাল করে বুঝে ওঠার সময় হয়নি এখনও।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:২৯
Share:

এটিএমে লাইন বনগাঁয়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

কয়েক ঘণ্টার নোটিসে বাতিল হয়ে গিয়েছে ৫০০ ও ১০০০ টাকার সব নোট। সেই সিদ্ধান্ত ভাল না খারাপ, সেটা ভাল করে বুঝে ওঠার সময় হয়নি এখনও। তার আগেই দৈনন্দিন দিনযাপনের প্রয়োজনে হাতে নিতে হয়েছে বাজারের থলি। পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সংশয় নিয়েই কেনাকাটা চলেছে। কোথাও কোথাও গোলমালের ঘটনাও ঘটেছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সারা দিন উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে ঘুরে চোখে এসেছে টুকরো টুকরো অনেক ছবি।

Advertisement

ঘটনা ১: ক্যানিং মাছ বাজারে এক কেজি কাতলা মাছ দিতে বলে ৫০০ টাকার নোট এগিয়ে দিলেন এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি। মাছ বিক্রেতা জানালেন, ৫০০ টাকা ভাঙাতে গেলে ৪০০ টাকার মাছ কিনতে হবে।

ঘটনা ২: গোসাবা স্টেশনের পাশে একটি ভাতের হোটেলে খাওয়ার পরে কাউন্টারের ছেলেটির দিকে ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দিলেন এক যুবক। ছেলেটি জানাল, বিলের টাকা ছাড়াও অতিরিক্ত ৫০ টাকা দিতে হবে। তবেই বাকি টাকা ফেরত হবে।

Advertisement

ঘটনা ৩: শ্যামনগর স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে রামপুরহাটের টিকিট চেয়ে ৫০০ টাকা দিলেন এক ব্যক্তি। কাউন্টারের ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘‘পরিচয়পত্র দিন, তবেই খুচরো দিতে পারব।’’

ঘটনা ৪: ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প থেকে জ্যারিকেনে করে তেল নিয়ে বেরোতে দেখা গিয়েছে। কারণ, ৫০০ টাকা দিলে ওই টাকার সমপরিমাণ তেল নিতে হচ্ছে। অনেক মোটরবাইকের ট্যাঙ্কে অত তেল রাখার জায়গা নেই। অগত্যা জ্যারিকেনে তেল নিয়ে রেখে দেওয়া।

ঘটনা ৫: বসিরহাট পুরসভায় বসে কয়েকটি ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট নিয়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন পুরসভারই এক কর্মী। কারণ জিজ্ঞেস করায় জানালেন, স্ত্রী খুচরো করতে দিয়েছে। কিন্তু কোথাও খুচরো মিলছে না। তাই তিনি ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন।

উপরের ঘটনাগুলি নির্দিষ্ট জায়গার হলেও একই ঘটনা দুই জেলার অন্য এলাকাতেও দেখা গিয়েছে। মঙ্গলবার নোট বাতিলের খবর শোনার পর থেকেই এটিএমগুলিতে লম্বা লাইন দেখা যায়। মধ্যরাত পর্যন্ত সেই লাইন ছিল। বনগাঁ থেকে কাকদ্বীপ সব জায়গাতেই এটিএম থেকে ১০০ টাকার নোট তোলার সঙ্গে অনেকে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট জমা দেন।

কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ১১ নভেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল, সরকারি ওষুধের দোকান, পেট্রোল পাম্প, ট্রেন, বাস, দুগ্ধ বিক্রয় কেন্দ্রে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে ছাড় রয়েছে। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে পেট্রোল পাম্প, ট্রেন, বাসের টিকিট টাকার সময়ে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট নিতে অস্বীকার করা হয়েছে। পেট্রোল পাম্পগুলিতে মধ্যরাত পর্যন্ত লাইন ছিল। ভোর থেকে ফের ৫০০ এবং ১০০০ টাকা দিয়ে তেল নেওয়ার লাইন শুরু হয়। খুচরো দেওয়া নিয়ে বচসাও হয়।

শ্যামনগরের একটি পেট্রোল পাম্পের মালিক তাপস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এর আগে গভীর রাতে তেল নেওয়ার নাম করে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। তাই গভীর রাতে তেল বিক্রি করতে ভয় পাই। তার পরেও মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত তেল দেওয়া হয়েছে। বুধবার যতক্ষণ খুচরো ছিল দিয়েছি। খুচরো শেষ হয়ে গেলে কী করতে পারি!’’ কাকদ্বীপের একটি পেট্রোল পাম্পের মালিক চন্দন বেরার দাবি, ‘‘মঙ্গলবার রাত থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার খুচরো দিয়েছি। কিন্তু খুচরো শেষ হয়ে যাওয়ায় বুধবার সকাল থেকে দিতে পারিনি।’’ ফলে অনেকেই ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকার তেল কেনেন। অনেককে ট্যাঙ্ক ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরে বাড়তি তেল জ্যারিকেনে ভরতে দেখা যায়। যদিও ইন্ডিয়ান অয়েলের এক কর্তা জানিয়েছেন, জ্যারিকেনে তেল দেওয়ার কোনও নিয়ম নেই। যে পাম্পে খুচরোর কারণ দেখিয়ে এ রকম করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ক্যানিং রেল স্টেশনের এক কর্মী জানান, সকালের দিকে ৫০০, ১০০০ টাকার নোট নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খুচরো টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আর নেওয়া সম্ভব হয়নি। কাকদ্বীপ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের এক কর্মী জানান, খুচরো শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি বাসে কন্ডাক্টর ৫০০ টাকা নিতে না চাওয়ায় গোলমাল হয়েছে। বসিরহাট জামরুলতলায় বিদ্যুৎ দফতরে ৫০০ এবং ১০০০ টাকা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখানো হয়। খুচরো ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে পোশাক বিকিকিনিতেও সমস্যা হয়। ডায়মন্ড হারবারের পোশাক বিক্রেতা শ্যামল দাস, কমল পুরকাইতরা বলেন, ‘‘পোশাক কেনার পরে সকলেই ৫০০-১০০০ টাকার নোট দিচ্ছেন। আমরা নিতে পারছি না। ফলে বিক্রি অনেক কমে গিয়েছে।’’

সাধারণ মানুষের এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে খুচরোর কালোবাজারির অভিযোগ এসেছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, ৫০০ টাকা খুচরো করে দেওয়ার জন্য ৩০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়েছে। ডায়মন্ড হারবার স্টেশন চত্বরে এ দিন কয়েক জনকে নিচু গলায়, ‘খুচরো লাগবে?’ প্রশ্ন করতে দেখা গিয়েছে। অনেক গ্রামে ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘর নেই। সেই সব এলাকায় ‘বাটা’র বিনিময়ে টাকা ভাঙানো চলছে। সুন্দরবন লাগোয়া প্রত্যন্ত গ্রামে বুধবার রাত পর্যন্ত ‘বাটা’র দর ছিল ৫০০ টাকায় ১০০ এবং ১০০০ টাকায় ২০০। কয়েক জন ফড়ে গ্রামে ঘুরে সেই দর হাঁকছেন। কেউ কেউ আবার গ্রামবাসীদের কাছে গিয়ে বলছেন, ব্যাঙ্কে বেশি টাকা নিয়ে গেলে কিন্তু হিসেব চাইবে, তার চেয়ে ‘বাটা’ দিয়ে টাকা ভাঙিয়ে নিন। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, কালো টাকা উদ্ধারের সময়ে যাতে আবার নতুন করে কালোবাজারি শুরু না হয় সে দিকে নজর দিক প্রশাসন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন