Jessore Road

গাছ লাগানো তো দূর, বনসৃজনের জমি নিয়েই ধোঁয়াশা

এপিডিআর-এর একটি সূ্ত্র জানাচ্ছে, যশোর রোডে গাছ কাটা নিয়ে মামলার সময়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে গাছ কাটার প্রসঙ্গ আদালতে তোলা হয়েছিল।

Advertisement

ঋষি চক্রবর্তী

বারাসত শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৭:৫১
Share:

রাস্তা চওড়া হয়েছে। বেড়েছে গাড়ির গতি। কিন্তু গাছের ছায়ার শীতলতা উধাও। ছবি: সুদীপ ঘোষ

রাস্তা চওড়া করতে ক’টি গাছ কাটা পড়েছে?

Advertisement

বিকল্প বনসৃজনের জন্য কোথায় ক’টি গাছ লাগানো হয়েছে?

সে সব গাছ বেঁচেবর্তে আছে তো?

Advertisement

প্রশ্নগুলো সহজ, তবে উত্তর অজানাই।

রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন বেশ কিছু গাছ কেটে সম্প্রতি চওড়া করা হয়েছে পূর্বতন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের (অধুনা, ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক) বারাসত থেকে সন্তোষপুর মোড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার রাস্তা। পথের দু’ধারে শ’দুয়েক প্রাচীন গাছ কাটা পড়েছিল বলে দাবি স্থানীয় মানুষের।

সরকার বাহাদুরের খাতায়-কলমে একটি গাছ কাটলে পাঁচটি গাছ লাগানোর কথা। কিন্তু জাতীয় সড়কের এই অংশে এত গাছ কাটা পড়লেও কোথায় কত বিকল্প গাছ লাগানো হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর ধোঁয়াশা। গাছ লাগানোর জমি আদৌ পাওয়া গিয়েছিল কি না, জানাতে পারেননি প্রশাসনের কর্তারা। এলাকার বাসিন্দারাও মনে করতে পারছেন না, সরকারের কাউকে রাস্তার ধারে গাছ লাগাতে দেখেছেন কি না।

এপিডিআর-এর একটি সূ্ত্র জানাচ্ছে, যশোর রোডে গাছ কাটা নিয়ে মামলার সময়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে গাছ কাটার প্রসঙ্গ আদালতে তোলা হয়েছিল। সরকার বিকল্প বনসৃজনের জন্য কী ব্যবস্থা করেছে, তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সে সময়ে দেখা যায়, সরকার যে জমিতে গাছ লাগানোর কথা বলেছে, সে জমির কোথাও আছে পাকাবাড়ি, কোথাও চাষের জমি, কোথাও জলা জমি।

এপিডিআরের বারাসত শাখার সম্পাদক বাপ্পা ভুঁইঞা বলেন, ‘‘যে গাছগুলি কাটা পড়েছে, সেগুলি সবই প্রাচীন গাছ। তাদের একটা কাটার পরে পাঁচটা পুঁতলেও ক্ষতিপূরণ হতে প্রচুর সময় লাগে। হয় তো সঠিক ক্ষতিপূরণ হয়ও না। তারপরেও সরকার নিজেই সে নিয়ম মানে না। গাছ লাগানোর জন্য সরকার এখনও জমিই তৈরি করতে পারেনি বলে আমাদের পর্যবেক্ষণ।’’

যশোর রোডের গাছ কাটা নিয়ে কয়েক মাস আগে মামলা করেছিল একটি বৃক্ষপ্রেমী সংস্থা।

সে সময়ে তথ্য জানার অধিকার আইনে তারা জানতে চায়, ৩৪ নম্বর সড়কের দু’পাশের ক’টি গাছ কাটা হয়েছে? রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, বারাসত থেকে বহরমপুর পর্যন্ত ১৯,৭৭৫টি গাছ কাটা হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগের বয়স দেড়শো পেরিয়েছে। তবে বারাসত থেকে সন্তোষপুর অংশে কত গাছ কাটা পড়েছে, কত গাছ লাগানো হল— সে সবের পরিসংখ্যান মেলেনি।

সন্তোষপুরের বাসিন্দা নিতাই মণ্ডলের কথায়, ‘‘আগে এত গাড়ি চলত না এই পথে। এখন প্রচুর গাড়ি বেড়েছে। ফলে দূষণ ছড়াচ্ছে। অথচ, গাছ লাগানোর কোনও চেষ্টাই নেই। ধোঁয়ার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় চাষবাসে। বেড়েছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। আজ যা স্থানীয় সমস্যা বলে মনে হচ্ছে, তা কিন্তু আসলে সামগ্রিক ভাবেই পরিবেশের সমস্যা। এর কবল থেকে কেউ বাদ যাবে না।’’ ময়নার বাসিন্দা রবিউল আলম বলেন, ‘‘সরকার পরিবেশ বাঁচাতে গাছ লাগানোর কথা বলে। প্রচার করে। অথচ, নিজেরাই সেই কাজটা করে না।’’ তবে তাঁর মতে, রাস্তার ধারে যে সব মানুষের জমিজমা আছে, তাঁদের নিজেদের উদ্যোগেই গাছ লাগানো উচিত। বৃক্ষপ্রেমী মোনালিসা ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘মঞ্চ বেঁধে গাছ বিলি করা হয়। পরিবেশ মেলা হয়। সেখান থেকেও গাছ বিতরণে করেন মন্ত্রী-সান্ত্রীরা। অথচ, কাজের কাজ কিছুই হয় না।’’

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ একেএম ফারহাদ বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছরের মধ্যে করোনাতেই তো কেটে গেল প্রায় তিন বছর। তবুও এর মধ্যে চেষ্টা করেছি বৃক্ষরোপণের। এই সময়ে সবুজশ্রী প্রকল্পে ১ লক্ষ ৯৪ হাজার ৩৮৩টি গাছ লাগানো হয়েছে ২৬ হেক্টর জমিতে।’’

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণে বারাসতের পর থেকে কিছুটা অংশে যে সব গাছ কাটা গিয়েছে, তার পরিবর্তে কত গাছ লাগনো হল? কোথায় লাগানো হয়েছে সে সব গাছ? ফারহাদ জানান, ‘‘কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। বিকল্প গাছ নিশ্চয়ই লাগানো হয়েছিল।’’

কিন্তু স্থানীয় লোকজন যে বলছেন, সরকারকে গাছ লাগাতে তাঁরা দেখেননি। এর আর স্পষ্ট উত্তর নেই বন কর্মাধ্যক্ষের কাছে।

দু’দশক আগেও ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ছিল সবুজে ঘেরা। রাস্তার দু’পাশে ছিল প্রাচীন বহু গাছ। চৈত্র-বৈশাখের প্রখর রোদের মধ্যেও এ পথ ছিল যাতায়াতের পক্ষে আরামদায়ক। তাপমাত্রা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকত এই রাস্তায়। চোখেরও আরাম হত যাত্রীদের। বিকেল হতেই শোনা যেত পাখিদের কিচিরমিচির।

এখন সব শুনশান। শুধু হুসহাস করে ধোঁয়া উড়িয়ে চলছে গাড়ি। প্রবল গরমে সামান্য বিশ্রাম নিতে রাস্তার পাশে চায়ের দোকান, ধাবায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। গৃহহারা হয়েছে লক্ষাধিক পাখি। পরিবেশ প্রেমীদের প্রশ্ন, এত উদাসীনতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে আনছে না তো!

রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘নিয়ম হচ্ছে, একটি গাছ কাটলে পাঁচটি গাছ লাগাতে হবে। যারা কাটবে, এটা তাদের কাজ। আমাদের কাছে জমি ও গাছ চাইলে দিয়ে দেব। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ক্ষেত্রে ওরা চাইলে দেব। জমি দেখিয়ে দিক। বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে আছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন