ট্রান্সফর্মারের গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।
খোদ বিদ্যুৎমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না চেওড়া গ্রামের অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। সরিষা গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই গ্রামে স্কুলের মধ্যেই একটি আস্ত ট্রান্সফর্মার বসানো রয়েছে। সেই ট্রান্সফর্মারটি আবার মাঝেমধ্যেই বিগড়ে যায় বলে অভিযোগ। ফলে শিশুদের দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই পড়াশোনা করতে হচ্ছে ওই স্কুলে।
ট্রান্সফর্মারটি সরিয়ে ফেলতে আট বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন, আবেদন-নিবেদন চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামবাসী এবং ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে মার্চ মাসে ওই ট্রান্সফর্মার সরাতে বিদ্যুৎ দফতর থেকে স্কুলের কাছে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা চাওয়া হয়েছে। যা স্কুলের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব বলে জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। সে কারণে এ বার লাগাতার পথ অবরোধের কর্মসূচি নিচ্ছেন তাঁরা।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ মসিউর রহমান বলেন, ‘‘এটি দেড়শো বাচ্চার একটা প্রাথমিক স্কুল। এত টাকা কোথা থেকে পাব? আমাদের আলাদা কোনও তহবিলও বরাদ্দ থাকে না। তাই জানিয়ে দিয়েছি, টাকা দেওয়া সম্ভব নয়।’’ স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ট্রান্সফর্মার সরানোর দাবিতে এর আগে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বিদ্যুৎমন্ত্রী, দফতরের বিভিন্ন আধিকারিককের কাছে যাওয়া হয়েছে। তালিকা থেকে বাদ যায়নি রাজনৈতিক নেতারাও। এই সমস্যা প্রায় এলাকার সমস্ত নেতারাই জানেন। এরপরেও এমন একটি চিঠিতে অবাক স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা।
কিন্তু বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা বলছেন, তাঁদেরও কিছু করার নেই। এটাই দফতরের নিয়ম। কোনও ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা জায়গা থেকেও যদি ট্রান্সফর্মার সরানোর আবেদন করা হয়, তবে সেই ব্যক্তি বা মালিকদের কাছে টাকা চাইবে বিদ্যুৎ দফতর। সেই টাকা দিলে তবেই তা সরানোর কাজ শুরু হবে। কাজের জন্য মালপত্র, শ্রমিক আর তদারকির জন্য মাস দু’য়েক আগে ওই অঙ্কের কোটেশন পাঠানো হয়েছে স্কুলে। গ্রামবাসীদের দাবি, কাছেই চেওড়া মসজিদ। এর আগে বিপজ্জনক ভাবে যার উপর দিয়ে তার গিয়েছিল। ভিন রাজ্য থেকে আসা এক নমাজি তাতে ছোঁয়া লেগে মারা যান। তারপরে বিক্ষোভ হয়েছিল। কোনও টাকা ছাড়াই সেই তার সরানো হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে যদিও বিদ্যুৎ দফতরের কর্তাদের দাবি, টাকা নিয়েই সরানো হয়েছিল ওই ট্রান্সফর্মারটি।
স্কুলের পক্ষে এত টাকা দেওয়া যে মুশকিল, সে কথা মানছেন এলাকার বিধায়ক দীপক হালদার। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল থেকে এত টাকা দিতে পারবে না। আমি বিষয়টি ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে জানিয়েছি। কিছু একটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।’’
এলাকার বহু ছেলেমেয়ে ওই স্কুলটিতে পড়ে। পঞ্চায়েতের সদস্য সাইনা বিবির দুই ছেলে ওই স্কুলেই পড়ে। তিনি জানান, বর্ষায় ওই ট্রান্সফর্মারের বিভিন্ন অংশ থেকে অনেক সময় বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। যা যখন-তখন বিপদ ডেকে আনতে পারে। এর আগে সর্বশিক্ষা মিশন থেকে ডায়মন্ড হারবার দক্ষিণ চক্রের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু এবং প্রতিবন্ধকতা যুক্ত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ওই প্রাথমিক স্কুলে একটি বিশেষ কেন্দ্র করার কথা ছিল। কিন্তু পরিদর্শকেরা ওই বিপজ্জনক ট্রান্সফর্মারের জন্যই তাতে সম্মত হননি। স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই বাচ্চারা এসে ঘোরাঘুরি করছে ট্রান্সফর্মারের কাছে। খেলাচ্ছলে তা থেকে বেরিয়ে থাকা একটি-দু’টি তার ধরেও টানাটানি করছে। এর মধ্যেই যদি কোনও বিপদ ঘটে যায়, তা হলে আর রক্ষা থাকবে না।
ভয়ে ভয়ে থাকেন স্কুলের শিক্ষিকারাও। একজন বললেন, ‘‘নিয়মিত ওটা থেকে আগুনের ফুলকি ঝরে। নানা রকম আওয়াজ হয়। বাচ্চারা যাতে ট্রান্সফর্মারের সামনে না যায়, সে দিকে নজর দেওয়া হয় ঠিকই— কিন্তু এতগুলি বাচ্চাকে সব সময়ে সামলানোও যায় না।’’ স্কুলের অভিভাবক নাজির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘‘ক’দিন আগেই একটি শিশু ট্রান্সফর্মারের মেন স্যুইচ অফ করে দিয়েছিল। আমাদেরই ছেলেমেয়েরা পড়ে। স্কুলে পাঠানোর পর থেকেই ভয়ে থাকি।’’