উড়ে আসে গানের কলি, মন্তব্য

কলা বিনুনি দুলিয়ে দুই ছাত্রী বড় রাস্তা ছেড়ে স্কুলের গলিতে ঢুকতেই ভেসে এল, ‘‘কী করে তোকে বলব, তুই যে আমার...।’’ রাস্তার অর্ধেক জুড়ে চলছে ক্যারম খেলা। লক্কা চুল, শুকনো চেহারার উঠতি যুবকের বুক খোলা শার্ট।

Advertisement

সামসুল হুদা

 ক্যানিং শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৪৩
Share:

কলা বিনুনি দুলিয়ে দুই ছাত্রী বড় রাস্তা ছেড়ে স্কুলের গলিতে ঢুকতেই ভেসে এল, ‘‘কী করে তোকে বলব, তুই যে আমার...।’’

Advertisement

রাস্তার অর্ধেক জুড়ে চলছে ক্যারম খেলা। লক্কা চুল, শুকনো চেহারার উঠতি যুবকের বুক খোলা শার্ট। সেই ছুড়ে দিয়েছিল বাংলা ছবির গানের কলি। মাথা নিচু করে পা চালিয়ে স্কুলে ঢুকে পড়ল দুই ছাত্রী। ক্যানিঙের দ্বারিকানাথ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে এমন ঘটনা নাকি হামেশাই ঘটে!

শুধু এই স্কুলে নয়, মহকুমার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সামনে স্কুল শুরু এবং ছুটির সময়ে প্রায়ই দেখা যায় রঙ-বেরঙের পোশাক পরে বিভিন্ন স্টাইলে চুল কেটে, চোখে সানগ্লাস পরে মোটরবাইকে চড়া যুবকদের ভিড়। এ সব উপেক্ষা করেই স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে হয় মেয়েদের। মাঝে মধ্যে সহ্যের সীমা ছাড়ায় রোমিওরা। অশালীন আচরণ করতেও পিছু হঠে না।

Advertisement

নারী পাচার যে জেলার বড় সমস্যা, সেখানে প্রায়শই প্রেমের ফাঁদে পড়ে স্কুলের মেয়েরা। তাদের অনেকে হারিয়ে যায় অন্ধকার জগতে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, সম্প্রতি ক্যানিঙের দ্বারিকানাথ বালিকা বিদ্যালয়ের একটি মেয়ে এমনই এক রোমিওর প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল। তাকে পুণেতে নিয়ে গিয়ে বিক্রির চেষ্টা করা হয়। পরে ক্যানিং থানার পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

ক্যানিঙের রায়বাঘিনি হাইস্কুলের সামনে প্রায়ই আড্ডা মারে একদল যুবক। জানা গিয়েছে, নানা ভাবে তারা কটূক্তি করে মেয়েদের। এমনই একদিন ছাত্রীকে অশ্লীল মন্তব্য করেছিল এক যুবক। সেই ছাত্রী স্কুলের গেটে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীকে বলে দেয়। সেই নিরাপত্তারক্ষী প্রতিবাদ করলে রোমিওদের সঙ্গে তাঁর বচসা বাধে। হাতাহাতি হয়। খবর পেয়ে পুলিশ যেতেই পালায় বখাটে ছেলের দল।

বুধবার দেখা গেল তালদি সুরবালা গার্লস হাইস্কুলের এক ছাত্রী সাইকেল করে স্কুলে আসছে। পিছনে একটি মোটরবাইকে তিন যুবক তাকে নানা ভাবে উত্যক্ত করছিল। একবার বাইক নিয়ে সাইকেলকে ওভারটেক করে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখছে। আবার কখনও মেয়েটির পিছন পিছন যেতে যেতে নানা মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে।

ওই স্কুলের সামনেই দেখা গেল, বেশ কিছু যুবক স্কুলের উল্টো দিকের একটি দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আড্ডা মারছে। আর বিভিন্ন মেয়েদের দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, কার পছন্দ কাকে। থেকে থেকে উঠছে হাসির গমক। অশ্লীল মন্তব্য।

ক্যানিঙের ডেভিড সেশুন হাইস্কুলে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি কো-এডুকেশন। স্কুলের এক একাদশ শ্রেণির ছাত্রী জানায়, স্কুলের সামনে রোমিওরা তেমন ভিড় জমাতে পারে না। কারণ এখানে শুধুমাত্র একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতেই মেয়েরা পড়ে। তারা কিছুটা বড়। তার উপরে মেয়েদের সঙ্গে সহপাঠী ছাত্ররাও থাকে অনেক সময়ে। তবে একেবারে কটূক্তি শুনতে হয় না, এমনটাও নয়।

ক্যানিং বা তালদি স্টেশন থেকে অনেকটাই ভিতরের দিকে ট্যাংরাখালি ঋষি বঙ্কিম সর্দার কলেজ। অভিযোগ, বহিরাগত ছেলেরা প্রায়ই কলেজের আশেপাশে ভিড় জমায়। এ দিন কলেজের সামনে গিয়ে দেখা গেল, তিনটি মেয়ে হেঁটে কলেজে আসছে। পিছু পিছু দু’টি সাইকেলে চার যুবক। ওই ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলছে। মেয়েগুলি নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। হঠাৎ ছেলেগুলি বেল বাজিয়ে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে মেয়েদের ওভারটেক করে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েদের কিছু একটা দিতে চাইল ছেলেগুলি। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে সোজা কলেজের দিকে পা বাড়াল মেয়েরা। এক ছাত্রী বলেন, ‘‘যা দিনকাল পড়ছে, একা কলেজে আসতেই ভয় করে। বন্ধুরা এক সঙ্গে আসি। দিন দিন ওদের বেয়াদপি যেন বেড়ে যাচ্ছে।’’

একাধিক বার দেখা গিয়েছে দ্বারিকানাথ বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিপদ ডেকে আনছে। প্রধান শিক্ষিকা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘‘ছোট ছোট মেয়েরা অনেক সময় ভুল করে ফেলে। তারা সঠিকটা বুঝতে পারে না। তা ছাড়া, এখন তাদের বোঝার বয়সও নয়। আমরা স্কুলে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংস্থা ও পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে সচেতনতা ক্যাম্প করি।’’ তাদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্যই এই উদ্যোগ বলে জানান তিনি। অভিভাবকদের নিয়েও একটি কমিটি করা হয়েছে। অনেক অভিভাবকই স্কুলের আশেপাশে পাহারা দেন। তা ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে সিভিক ভলান্টিয়ার দেওয়া হয়েছে।

মহকুমা পুলিশ আধিকারিক সৌম্য রায় বলেন, ‘‘স্কুলে শুরু ও ছুটির সময়ে বিভিন্ন স্কুলের সামনে আমাদের নজরদারি থাকে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই জিজ্ঞাসাবাদ করি। তেমন হলে ওই সব ছেলেদের ধরে নিয়ে এসে তাদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দিই, সাবধান করে দেওয়া হয়। তা ছাড়া, স্কুলগুলিতে ক্যাম্প করে বলা হয়, তেমন সমস্যা হলে আমাদের হেল্প লাইন ১০০ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানাতে।’’

তবে মেয়েদের অভিজ্ঞতা হল, পুলিশ যদি সত্যি এতই তৎপর হতো, তা হলে নিত্য নৈমিত্তিক এই যন্ত্রণা, অপমান সহ্য করতে হতো না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন