নোনা ইছামতী, বৃষ্টিই ভরসা

নদীর উপরে ভরসা করে চাষ করেছিলেন বহু চাষি। কিন্তু নোনা জল ঢুকে পড়ায় নদীর উপরে সেই ভরসাও রাখতে পারছেন না মাধবপুর, মণিগ্রামের মানুষজন। ফলে চোখের সামনে ফসল নষ্ট হয়ে যেতে দেখলেও কার্যত হাত-পা বাঁধা বনগাঁ ব্লকের ধর্মপুকুরিয়া পঞ্চায়েতের চাষিদের। স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরে মাধবপুর, মণিগ্রাম, শুকপুকুর ও সভাইপুর মৌজার চাষিরা সেচের জন্য ইছামতী নদীর জলই ব্যবহার করে আসছেন।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০২:০৩
Share:

সেচের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে কলাগাছ। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

নদীর উপরে ভরসা করে চাষ করেছিলেন বহু চাষি। কিন্তু নোনা জল ঢুকে পড়ায় নদীর উপরে সেই ভরসাও রাখতে পারছেন না মাধবপুর, মণিগ্রামের মানুষজন। ফলে চোখের সামনে ফসল নষ্ট হয়ে যেতে দেখলেও কার্যত হাত-পা বাঁধা বনগাঁ ব্লকের ধর্মপুকুরিয়া পঞ্চায়েতের চাষিদের।

Advertisement

স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরে মাধবপুর, মণিগ্রাম, শুকপুকুর ও সভাইপুর মৌজার চাষিরা সেচের জন্য ইছামতী নদীর জলই ব্যবহার করে আসছেন। নদী থেকে জল খেতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ওই সব এলাকায় ৯টি সরকারি পাম্প রয়েছে। সাতটি পাম্প সচলও আছে। নোনা জল ঢুকে পড়ায় নদীর জলও ব্যবহার করতে পারছেন না চাষিরা। ফলে বিঘার পর বিঘা ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, চাষিদের চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ নেই। মাঠ থেকে মুখে গোমরা ফিরে আসছেন। মোড়ে মোড়ে চাষিরা নিজেদের মধ্যে আর্থিক ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করছেন।

চাষিরা জানালেন, ইছামতীতে এপ্রিল মাসের গোড়ায় নোনা জল ঢুকেছে। নোনা জলের কারণে বোরো ধানের উৎপাদনও কম হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বোরো চাষিরা নদীর ওই নোনা জলই সেচের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। নোনা জল যে ঢুকেছে প্রথমের দিকে অনেকেই বুঝতে পারেননি। খেতের পাশে তাঁদের এই আক্ষেপের কথা বলছিলেন এলাকার চাষি তথা বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য মনোরঞ্জন ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণ ভাবে বিঘে প্রতি জমিতে ১৮-২০ মন ধান হওয়ার কথা। কিন্তু নদীর নোনা জল সেচের কাজে ব্যবহার করায় ওই উৎপাদন কমে হয়েছে ১০ মন।’’ বোরো চাষে ওই সব এলাকায় এ বার লাভের মুখ দেখতে পাননি চাষিরা। মনোরঞ্জনবাবু তিন বিঘা জমিতে বোরো চাষ করে পেয়েছেন ৩০ মন ধান। যা স্বাভাবিক সময়ে হওয়ার কথা প্রায় ৬০ মন। দিলীপ ঘোষ নামে এক বোরো চাষি বললেন, ‘‘এক বিঘা জমিতে বোরো চাষে খরচ হয়েছিল ৮ হাজার টাকা। উৎপাদিত ১০ মন ধান বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার টাকায়।’’

Advertisement

শ্যালোর পরিবর্তে কেন চাষিরা ইছামতীর জল চাযে ব্যবহার করছেন?

চাষিদের বক্তব্য, গোটা বোরো মরসুমের জন্য (তিন মাস) রিভার পাম্পের মাধ্যমে নদীর জল সেচের কাজে লাগালে প্রতি একর জমিতে খরচ ৮১৬ টাকা। শ্যালোর মাধমে সেচ দিলে ওই খরচ কয়েক গুণ বেশি। তা ছাড়া, ওই সব এলাকায় শ্যালোর মাধ্যমে খেতে জল দেওয়া প্রক্রিয়া খুব বেশি চালু নেই। এখানে নদী নির্ভর সেচের উপরেই চাষিরা নির্ভর করে থাকেন। বর্তমানে সেচের জলের অভাবে আমন চাষিরা বীজতলা তৈরি করতে পারছেন না। এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, পাটের বৃদ্ধি হয়নি। বহু পাট গাছ শুকিয়ে গিয়েছে। পটল, ঝিঙে, কলা গাছও মরে যাচ্ছে জলের অভাবে। রবীন্দ্রনাথ ঘোষ চার বিঘা জমিতে কলা, বেগুন, পটল, পাট চাষ করেছেন। সব মরে যাচ্ছে বলে জানালেন তিনি। ওই চাষির কথায়, ‘‘নদীর জলে নোনা। ফলে ওই জল সেচের কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যাঁরা ব্যবহার করেছিলেন তাঁদের ফসল সব শেষ। শ্যালো মেশিন ভাড়া করে খেতে জল দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ এখানকার বেশির ভাগ চাষির নেই। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হচ্ছে।’’ ধর্মপুকুরিয়া পঞ্চায়েতের সদস্য আখতার আলি মণ্ডল বলেন, ‘‘ওই চারটি মৌজায় হাজারেরও বেশি চাষি রয়েছে। কৃষি জমির পরিমাণ প্রায় এক হাজার একর। সরকারি ন’টি রিভার পাম্পের মধ্যে সাতটি চলছে। অথচ চাষিরা ইছামতীর নোনা জল সেচের কাজে ব্যবহার করতে না পেরে চোখের সামনে সব্জি, পাট নষ্ট হয়ে যেতে দেখছেন। গত চার বছর ধরে চৈত্র মাসে নদীতে নোনা জল ঢুকছে। শ্রাবণ মাস পর্যন্ত ওই নোনা থাকছে। প্রবল বৃষ্টি হলেই একমাত্র ইছামতীর নোনা ভাব কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

আক্ষেপের কথা শোনালেন আর এক চাষি শ্যামপদ ঘোষ। তাঁর খেতের পাট শুকিয়ে মরে গিয়েছে। খেতে কাজ করছিলেন আতিয়ার মণ্ডল নামে এক চাষি। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘১০ কাটা জমিতে পাট লাগিয়েছিলাম। সব শেষ! নদী থাকতেও জল দিতে পারছি না। গত বছরও সমস্যা এতটা ছিল না।’’ চাষিরা জানালেন, এখানকার মাধবপুরের ডাঁটার সুনাম গোটা রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। বনগাঁ ও জেলার হাট বাজার ছাড়িয়ে এখানকার সব্জি কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি-সহ গোটা দেশে যায়। অথচ চার বছর ধরে নদীতে নোনা জল আসায় চাষিরা লাভের মুখ আর দেখছেন না। মনোরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘বহু চাষি চাষবাস ছেড়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের, কেউ বা রঙের মিস্ত্রির কাজ বেছে নিয়েছেন। এ ভাবে চলতে থাকলে চাষবাস মানুষকে বন্ধ করে দিতে হবে।’’

এলাকার চাষিরা তাঁদের ওই পরিস্থিতির জন্য ইছামতীর নদীর নাব্যতা হারানোকেই দায়ী করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, নদী সংস্কার না হলে, স্রোত না ফিরলে— পরিস্থিতির বিশেষ পাল্টাবে না। তবে এলাকার কিছু বড় চাষি অবশ্য শ্যালোর মাধ্যমে খেতে সেচ দিচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা ছোট ও প্রান্তিক চাষি তাঁদের পক্ষে ঘণ্টায় একশো টাকা খরচ করে সেচ দেওয়া সম্ভব নয়।

সমস্যার কথা জানেন কৃষি দফতরের কর্তাও। বনগাঁ ব্লকের সহকৃষি অধিকর্তা শঙ্করকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘ওই সব মৌজার চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যেন ইছামতীর নোনা জল সেচের কাজে ব্যবহার না করেন। নোনা জল ব্যবহার করলে ফসলের আরও বেশি ক্ষতি হবে। পুকুরের জল ওঁরা সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারেন। গোটা পরিস্থিতির কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’’

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিগরম ও নোনাজল— এই উভয় সঙ্কটে পড়ে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন