মেজাজটাই তো আসল রাজা। দোলনা টাঙিয়ে খেলা দেখছেন এক গ্রামবাসী। নিজস্ব চিত্র।
‘স্টেডিয়াম চলুন... কলকাতার বড় ক্লাবের ফুটবলারদের দেখার চান্স ছাড়বেন না’— বাস, ট্রেকার, ছোটগাড়িগুলির এই ডাকেই পিলপিল করে ভিড় জমল বসিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ ব্লকের পাটলিখানপুর পঞ্চায়েতের তাড়াগোপাল গ্রামে। সেখানে বসেছিল ফুটবলের জমজমাট আসর। ক্লাবের হয়ে প্রায় ৬৫ জন বিদেশি ফুটবলার-সহ কলকাতা ময়দানের বেশ কয়েকজন ফুটবলারের খেলা দেখতে ‘স্টেডিয়ামে’ উপচে পড়েছিল কচি, বুড়ো, জোয়ানের দল। মহিলা দর্শকের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।
বসিরহাট মহকুমায় ‘স্টেডিয়াম’ বলতে মানুষ বসিরহাট স্টেডিয়ামকেই বোঝেন। সম্প্রতি সেই স্টেডিয়ামের সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে রাজ্য সরকার। তা হলে কী নতুন কোনও স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে হাসনাবাদে?
এই কৌতূহল নিয়েই কাঠাখালি নদী পেরিয়ে পেরিয়ে পৌঁছন গেল সেখানে। গিয়ে দেখা গেল, কংক্রিটের নয়, কাঠের স্টেডিয়াম ভরে গিয়েছে মানুষে মানুষে। কলকাতার কোনও এক সার্কাস কোম্পানি থেকে ভাড়া করে যা এনে হাজির করেছেন আয়োজকেরা। আর স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার জন্য গুণতে হচ্ছে মাত্র ৫০ টাকা। মাটিতে বসলে খরচ আরও কম, ৩০ টাকা।
গাঁ-গঞ্জের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো সেই টাকা খরচ করেই প্রতি দিন মাঠ ভরিয়েছেন। মাঠের পাশে বাড়ির ছাদগুলিতেও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুটবলের সঙ্গেই দেদার বিকিয়েছে ঘুগনি-আলুরদম, চাটনি-পাঁপড়, বাদাম, আইসক্রিম থেকে শুরু করে বিরিয়ানি, সাদা ভাত, ঝুমঝুমি, পুতুল। রীতিমতো উৎসবের পরিবেশ।
মাঠে গিয়ে দেখে গেল, এক দিকে রয়েছে কাঠের স্টেডিয়াম। দু’দিকে বাঁশের মাচা। এক দিক ফাঁকা। মাচার উপরে রোদ, বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচাতে টাঙানো হয়েছিল পলিথিন-সহ রঙিন কাপড়। হাসনাবাদ ও সংলগ্ন এলাকা ছাড়া বাংলাদেশ থেকেও মাঠে এসেছেন অনেকে। বাড়ির ছাদ, স্কুল ঘরের কার্নিসও বাদ নেই। মাঠের এক কোণে খেজুর আর শিরিষ গাছের মাঝে দোলনা বেঁধেও খেলা দেখছিলেন এক জন! স্টেডিয়ামে জায়গা না পেয়ে পাশের বটগাছে ঝুলতে দেখা গেল কয়েক জনকে, যেন ‘ধন্যি মেয়ে’ সিনেমায় ফাইনালের সেই দৃশ্য! কাজকম্মো শিকেয় তুলে সকলে দিনভর খেলার মাঠে ব্যস্ত।
আয়োজক তাড়াগোপাল কিষাণ মজদুর ইউনাইটেড ক্লাবের তরফে জানা গেল, গ্রামের এই ফুটবল প্রতিযোগিতার বয়স নয় নয় করে ১৯ বছর। প্রতি বছরেই ঈদের পরে দু’দিনের ১৬ দলীয় এই নক আউট ফুটবলের আসর বসে। এ বারও ব্যতিক্রম হয়নি। এক একটি খেলার জন্য বরাদ্দ ছিল ২০ মিনিট করে। দু’দিনই সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল পর্যন্ত টানা খেলা চলেছে। এ বারের প্রতিযোগিতাটি আয়োজক কমিটি উৎসর্গ করেছিল প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের স্মৃতিতে। কমিটি জানিয়েছে, প্রতিযোগিতা থেকে আয় হওয়া টাকা সুন্দরবন এলাকার থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সাহায্যের খরচ করা হবে। আয়োজক ক্লাবের সম্পাদক গোলাম বারি গাজি বলেন, ‘‘সুদৃশ্য ট্রফি ছাড়াও চ্যাম্পিয়ন দলকে ১ লক্ষ ১ হাজার টাকা এবং রানার্স দলকে ৮১ হাজার টাকা আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হয়।’’ তবে সরকারি অনুদান না মেলায় উদ্যোক্তাদের ক্ষোভ আছে।
এ বার প্রতিযোগিতায় কলকাতা এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দল যোগ দিয়েছিল। ফাইনালে মুখোমুখি হয় রামেশ্বপুর প্যারাডাইস ক্লাব ও ঢোলখালি ভাই ভাই সঙ্ঘ। নির্ধারিত সময়ে কোনও গোল হয়নি। টাইব্রেকারে ২-৩ গোলের ব্যবধানে জয়ী হয় রামেশ্বরপুর প্যারাডাইস ক্লাব। খেলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তন্ময় ধর, ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী, মানিক মাঝি, কালীকিঙ্কর এবং আনন্দ মণ্ডল।
ফুটবল নিয়ে এমন আগ্রহ কেন, জানতে চাওয়া গেল কয়েক জনের কাছে। রামেশ্বরপুর গ্রামের ফজলুর হক, রাজ্জাক মিদ্দে, হিঙ্গলগঞ্জের বোলতলা গ্রামের আতিকুর রহমান, সুন্দরবন জঙ্গল-লাগোয়া ৩ নম্বর সামসেরনগরের ভবেন পাত্রদের কথায়, ‘‘ইচ্ছা থাকলেও সুন্দরবন এলাকার মানুষ কলকাতা কিংবা বারাসত গিয়ে বড় দলের খেলা দেখতে পারেন না। এই প্রতিযোগিতায় কলকাতা থেকে অনেকে খেলতে এসেছিলেন। অনেক বিদেশিও খেলেছেন। সামনে থেকে তাঁদের খেলা দেখতেই মাঠে এসেছি।’’
প্রত্যন্ত এলাকায় ফুটবল দেখতে পুরুষদের সঙ্গেই মাঠ ভরিয়েছিলেন মহিলারা। মাঠে ছিলেন যমুনা বিবি, খাইরুন্নেশা, কোহিনূর খাতুনদের মতো অনেকে। বাংলাদেশের দেভাটার পাঁচপোতা গ্রাম থেকে এসেছিলেন মনিরুল ইসলাম গাজি ও তাঁর বন্ধুরা। প্রত্যন্ত গ্রামে কাঠের স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার মজাই আলাদা, জানালেন তাঁরা। প্রতি বছর খেলার টানেই আসেন এ দেশে, তা-ও জানালেন।
মাঠে উপস্থিত বসিরহাট মহকুমার এক ক্রীড়া সংগঠন বললেন, ‘‘ফুটবলের আবেগ বাঙালির রক্তে। তাকে ভাঙিয়েই কর্পোরেট সংস্থা কোটি টাকার ব্যবসা করছে। বাংলার ফুটবল কর্তারা সে কথা কবে বুঝবেন?’’