শুধুই তীর্থস্থান নয়, সাগর মেলা এখন বিনোদনেরও কেন্দ্র। ছবি: শৌভিক দে।
এক দশক আগেও গঙ্গাসাগর যাত্রা মানে ছিল হোগলা পাতার ঘর, উন্মুক্ত আকাশের নীচে অস্থায়ী উনুন বানিয়ে রান্না, মকর সংক্রান্তির দিন হাড় কাঁপানো শীতে স্নান। আর ছিল সাধুসন্ত ও নাগা সন্ন্যাসীদের ভিড়।
কিন্তু এখন গঙ্গাসাগর মেলা মানে পরিবারের সঙ্গে একদিন ছুটি কাটাতে যাওয়ার নতুন ঠিকানা। বিগত পঁচিশ বছর ধরে এই মেলায় পুরোহিতের কাজ করেন এলাকার বাসিন্দা দূর্গাগতি পাহাড়ি। দূর্গাগতিবাবু জানান, এক কালে গঙ্গাসাগর মেলায় ছিল সাধু সন্ন্যাসীদের ভিড়। এখন তাঁদের সংখ্যাই কমে গিয়েছে। তা ছাড়া বছরভর লোকজন এখানে সপরিবারে বেড়াতে আসেন। মেলার সময় সেই ভিড় আরও বাড়ে।
পুণ্যার্থীদের একাংশ জানান, এককালে এই মেলার সকাল শুরু হত কয় ঘটিকায় স্নান সারতে হবে সেই ঘোষণার মাধ্যমে। এখন আর সেই ঘোষণা নেই। পরিবর্তে কোন শৌচালয় ফাঁকা রয়েছে, কোথায় লম্বা লাইন, বিনামূল্যের শৌচালয় কোথায় সেই ঘোষণা হয়। মেলা প্রাঙ্গণে শৌচালয়ের অভাব ছিল বরাবর। উন্মুক্ত স্থানেই শৌচকর্ম সারতেন বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু এখন প্রশাসনের তৎপরতায় মেলা প্রাঙ্গণ অনেক বেশি ঝা চকচকে। এই সব কিছুই আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে গঙ্গাসাগরকে। বনগাঁ থেকে এসেছেন অনিমা দাস। তাঁর কথায়, ‘‘গঙ্গাসাগর মেলা এখন ঝা চকচকে। বছর দু’য়েক আগেও এখানে এসে শৌচালয় নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। এ বার আর তা হয়নি। মহিলা পুলিশ হাত ধরে শৌচালয়ের বাইরে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।’’ আগে শৌচালয়গুলি নোংরা থাকত। সংখ্যায়ও কম .ছিল। ফলে সমস্যা হতো।
প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে বদলেছে গঙ্গাসাগর মেলার করুণ কাহিনীও। মেলায় এসে স্বজন হারিয়ে যাওয়া ছিল এক চেনা ছবি। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সেই হিসাবও বদলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গঙ্গাসাগরের মেলায় হারিয়ে যাওয়া মানুষদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তা ছাড়া এখন যাঁরা এখানে আসেন তাঁদের অধিকাংশ মোবাইল ব্যবহার করেন। সে কারণে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও নিজেরাই যোগাযোগ করে নেন। এলাকার টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে প্রশাসন আরও তৎপর হচ্ছে। শহুরে সুযোগ সুবিধা এখানে পৌঁছে দিতে পারলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ আসতে আগ্রহী হবেন বলে আশা করছেন প্রশাসনের কর্তারা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের জানান, এককালে লট ৮ ঘাটে বাঁধা থাকত সারি সারি নৌকো। পুণ্যার্থীরা নৌকা করে আসতেন কচুবেড়িয়ায়। সেখান থেকে কপিল মুনির আশ্রমে আসার জন্য ছিল মাত্র তিনটি বাস। দিনে মাত্র চারবার যাতাযাত করত। কিন্তু সে সব অতীত। এখন অসংখ্য বাস-গাড়ির পাশাপাশি প্রিপেড ট্যাক্সির বুথ করা হয়েছে মেলা প্রাঙ্গণে। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে গঙ্গাসাগরে আসেন কলকাতার বাসিন্দা অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়। বছর ৬৫ অরবিন্দুবাবু বলেন, ‘‘চোখের সামনে মেলার ভোল বদলাতে দেখলাম। এককালে নৌকা ছাড়া অন্য কোনও যানবাহন ছিল না। এত উন্নতি হয়েছে দেখেই এই বয়সেও আসতে পারছি।’’ এই বদলের জেরে মানুষের সমাগম বেড়েছে। এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘যাত্রাপথ যত মসৃণ হচ্ছে নিরাপত্তার কাজ দিন দিন আরও কঠিন হচ্ছে।’’ এক পুলিশ কর্তা জানান, আগে গঙ্গাসাগরে ডিউটি মানে মকর সংক্রান্তির দিন কড়া পাহারা। কিন্তু এখন তো মেলা শুরুর দিন থেকেই লোক আসতে শুরু করেন। আগে অনেক বেশি মানুষ এখানে রাত কাটাতেন। এখন অবশ্য রাতে ঘাট ফাঁকাই থাকে। তবু নজরদারি চলে।
বিবর্তন শুধু রাস্তাঘাট কিংবা যোগাযোগের মাধ্যমে ঘটেনি। বদলেছে মন্দির। পুজো দেওয়ার ধরনও। আগে বেশিরভাগ মানুষ নারকেল আর কলা দিয়ে পুজো দিতেন। কিন্তু এখন ডালার দোকান হয়েছে। দেদার বিক্রি হচ্ছে ডালা। মেলার সময় মন্দিরের চারপাশে বহু স্থানীয় মানুষ ফুলের দোকান দিতেন। এখন অবশ্য ইচ্ছে হলেই বাসিন্দারা যেখানে-সেখানে দোকান দিতে পারেন না। সরকারের তরফ থেকে ডালা-অর্কিডের দোকানিদের জন্য পাকা ঘর বানানো হয়েছে।
তবে এই বদলে খুশি নন গঙ্গাসাগরে আসা সন্ন্যাসীরা। তাঁদের একাংশ মনে করছেন, তীর্থক্ষেত্রে যাতায়াতের পথ এত মসৃণ হয়ে গেলে তার মাহাত্ম্য কমে যায়।