মিলন: সেলফিতে মগ্ন তরুণ প্রজন্ম। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
দৃশ্যটি বহু মানুষের স্মৃতিতে এখনও টাটকা। ঋত্বিক ঘটকের তৈরি ‘কোমলগান্ধার’ ছবি। দেশভাগের যন্ত্রণা বোঝাতে দু’দেশের সীমানায় হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া রেললাইনের সেই অনুষঙ্গ ফিরিয়ে আনে বহু চোখের জলের ইতিহাস।
বৃহস্পতিবার ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যাত্রাবাহী ট্রেন চলাচলের যে ইতিহাস নতুন করে তৈরি হল, তা ফিরিয়ে আনচে এমনই নানা স্মৃতিকথা। ঋত্বিকের ছবির শ্যুটিং পেট্রাপোলে হয়নি ঠিকই, কিন্তু আবেগের ইতিহাসটি এ প্রান্তের বাংলার দু’পাড়েও একই।
কলকাতা-খুলনা এক্সপ্রেস যখন ঢুকছে পেট্রাপোল স্টেশনে, বৃদ্ধ সনাতন দে-র সে কী উৎসাহ। কাঁটাতারের বেড়়ার রাজনীতি বোঝেন না বৃদ্ধ। শুধু একটা ট্রেনের গতিপথ তাঁর অশক্ত শরীর-মনটাকে টেনে নিয়ে যায় ছেলেবেলার দিকে। বৃদ্ধ বলে চলেন, ‘‘সে বার যখন বাবা-মায়ের হাত ধরে পেট্রাপোল স্টেশনে নামি, তারপর থেকে আর দেশে ফেরা হয়নি। এই ট্রেনটাই তো সে দিন উল্টো পথে আমাদের পরিবারটাকে এনে ফেলেছিল এ পার বাংলার মাটিতে। তারপর থেকে তো জীবনটাই বদলে গেল।’’ বৃহস্পতিবার কলকাতা-খুলনা বন্ধন এক্সপ্রেসকে ঘিরে এমনই আবেগের খণ্ডচিত্র ধরা পড়ল পেট্রাপোলে।
বেলা তখন ১২টা। তখনও টুকটাক লোকজন ঘোরাফেরা করছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ স্টেশন পেট্রাপোলে। বনগাঁ জিআরপি ওসি লোকনাথ ঘোষের নেতৃত্ব পুলিশ ও আরপিএফ জওয়ানেরা প্ল্যাটফর্মে টহল দিচ্ছেন। মিনিট ৪০ পরে যখন ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে, তখন গিজগিজ করছে ভিড়। অনেকেই আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছছেন। ট্রেনকে পিছনে রেখে সেলফি তোলারও ধুম পড়ল।
ট্রেন ঢোকার অনেক আগে থেকেই স্টেশন-চত্বরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন বৃদ্ধ অখিল হালদার। জানা গেল, তাঁর বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। ছোট বয়সে পিসিমার সঙ্গে ট্রেনে চেপে এ দেশে আসা। বেনাপোলে নেমেছিলেন সে বার। তখন অবশ্য কয়লার ইঞ্জিন। ভুসভুস করে ধোঁয়া ছাড়ে। সেই ট্রেনে চাপার মজাই রকম, বললেন বৃদ্ধ। ট্রেনের শব্দে নেশা লেগে যেত, বললেন অখিলবাবু।
অতীতে দু’দেশের মধ্যে এই লাইনে যাত্রিবাহী ট্রেন চললেও ষাটের দশকে তা বন্ধ হয়ে যায়। এ দিন থেকে ফের তা চালু হল। এপ্রিল মাসে ট্রেন পরক্ষীমূলক একদিন চলেছিল। সে বার ট্রেন এসেছিল এ পার থেকে। সে বারও এমনই আবেগ আর চোখের জলের সাক্ষী ছিল পেট্রাপোল স্টেশন।
জয়ন্তীপুর নিউ এফপি প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা এসেছিলেন। শিক্ষিকা পায়েল মণ্ডলের কথায়, ‘‘ছাত্রদের পাশের মাঠে খেলা ছিল। ট্রেন আসছে শুনে ওদের দেখাতে নিয়ে এলাম। এই ট্রেনের সঙ্গে তো আমাদের আগের প্রজন্মের বহু মানুষের বহু স্মৃতি আর আবেগ জড়িয়ে। ছেলেমেয়েদের বললাম সে কথা।’
ট্রেন মিনিট সাতেক ছিল স্টেশনে। তারপরেই বেনাপোলের দিকে রওনা দেয়। ট্রেন দেখতে বারাসত, হাবরা, গোবরডাঙা, বনগাঁ স্টেশনেও অনেকে ভিড় করেছিলেন। সে সব সামলাতে রেল পুলিশকে রীতিমতো হিমসিম খেতে হয়। ট্রেন বেরিয়ে যাওয়ার পরে স্টেশন চত্বর থেকে বেরোতে বেরোতে বৃদ্ধা সুখরানি মণ্ডল বলে গেলেন, ‘‘পুরনো কথা বড্ড মনে পড়ছে আজ। বাপ-দাদাদের মুখগুলো ভেসে আসছে।’’
আঁচলে জল আর স্মৃতি আগলে বাড়ির পথ ধরলেন বৃদ্ধা।