জমি দখলের লড়াইয়ে ক্রমশই বেপরোয়া হয়ে উঠছে মাফিয়ারা, সংগ্রামপুরের ঘটনা তা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
সংগ্রামপুরের মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ৩ শতক জমি পেরিয়ে পিছনের ২১ কাঠা জমিতে ঢুকতে হয়। বর্তমানে ওই পথবিহীন ‘কানা’ জমির মূল্য ৬ লক্ষ টাকা। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রের খবর, ওই ২১ কাঠা জমির বাজার দর বড়জোর ২ লক্ষ টাকার সামান্য বেশি হতে পারে। কিন্তু সিন্ডিকেটের হাতে গোটা জমিটা গেলে তার মূল্য বেড়ে দাঁড়াবে কমপক্ষে ৬০ লক্ষ টাকায়। দু’চার বছর ফেলে রাখতে পারলে কয়েক কোটি টাকাও ছুঁতে পারে!
এই লোভেই তিন শতক জমির মালিক তিন ভাইকে হুমকি দিতে শুরু করেছিল জমি মাফিয়ারা। কাজ না হওয়ায় দুষ্কৃতীদের ‘সুপারি’ দিয়ে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের তিন ভাইকে খুনের চেষ্টাও হয় বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
কিন্তু কেন এ ভাবে জমির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বসিরহাটে?
মহকুমা প্রশাসনের এক কর্তার মতে, তার কারণ বহুবিধ। একে তো বসিরহাটকে জেলা ঘোষণা করার প্রস্তুতি চলছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি ভবন হচ্ছে। একবার জেলা হিসাবে তৈরি হয়ে গেলে বসিরহাটে জেলাশাসক বসবেন, থাকবেন পুলিশ সুপার। অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস হবে। বাইরের লোকজনও থাকতে আসবেন কর্মসূত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই যে দিকে তাকিয়ে বাড়ছে জমির দাম। সে দিকে তাকিয়ে আগেভাগে সস্তায় জমি কিনে রাখতে চাইছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
তা ছাড়া, সীমান্ত এলাকা হওয়ায় নানা অবৈধ কারবারের রমরমা বসিরহাটে। যার মধ্যে গরু পাচার, সোনা পাচার বা আরও নানা জিনিস পাচারের কাজে জড়িয়ে আছে অনেকেই। তাদের হাতে কাঁচা টাকার অভাব নেই। চোরাপথে বাংলাদেশ থেকে এসে এ দেশে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে অনেকে। জাল ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট আছে তাদের। এই শ্রেণির হাতেও টাকার জোগান অফুরন্ত। তারাও যে কোনও মূল্যে ভাল জমি, ফ্ল্যাট কিনতে তৈরি। সুযোগ বুঝে বাড়তি দাঁও মারতে প্রস্তুত জমি-বাড়ির দালালেরাও।
এরই মাঝে বসিরহাটের ঘোজাডাঙা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে হিলি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। ওই রাস্তা হলে সীমান্তে ব্যবসা আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে হাওয়ায় টাকা ওড়ার নানা পথ খোলা উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তবর্তী এই এলাকায়।
শিল্পের পরিবেশ তেমন না থাকলেও বসিরহাটে কিছু কিছু ব্যবসা দীর্ঘ দিন ধরেই ভাল চলে। যার মধ্যে অন্যতম হল ভেড়িতে মাছ চাষ। এ ছাড়াও আছে ইটভাটা। হাইব্রিড মাগুর মাছের চাষ। এই সব ব্যবসার সবটা বৈধ পথে চলে না। কিন্তু এ সব ব্যবসায় লাভের অঙ্কটা আকাশ ছোঁয়া। মুনাফার অঙ্কটা যদি কালো টাকায় আসে, তা হলে তার খরচের ক্ষেত্রেও হিসাবে-নিকেশের ধার ধারে না কেউ। ফলে এই সব ব্যবসার বৈধ-অবৈধ টাকা মিলেমিশে বসিরহাটে সম্পত্তির দাম বাড়িয়েছে হু হু করে। ক’বছর আগেই বসিরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতীর এক পাড়ে বেশির ভাগই ছিল কাঁচা বাড়ি। অন্য পারে ইটের তৈরি বড় জোর দোতলা বাড়ি কিছু কিছু দেখা যেত। ইদানীং ইছামতীর এক পাড়ে, সংগ্রামপুরের দিকে কাচ লাগানো দু’তিন তলা বাড়ি, অন্য পাড়ে পাঁচ-ছ’তলা সুদৃশ্য ফ্ল্যাটও চোখে পড়ছে। শহরের একের পর এক তৈরি হচ্ছে বড় বড় দোকান, মল।
কয়েকজন জমি ব্যবসায়ী জানালেন, বসিরহাট সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে অধিকাংশ ব্যবসা লাভজনক। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের একটা বড় অংশ বাংলাদেশে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জমি-বাড়ি বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে মানুষ আসছেন এ পারে। তাঁদের একটা বড় অংশ শহর-সংলগ্ন এলাকায় ব্যবসা কিংবা থাকার জন্য দোকান, বাড়ি খুঁজছেন। বেশি টাকা খরচ করতেও প্রস্তুত তাঁরা। ভাল জায়গায় জমি পেতে খরচ যেমনই হোক, দু’বার ভাবেন না এঁরা। জমির দালালিও ফলে দিন দিন লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠছে। সহজে বেশি রোজগারের আশায় অল্পবয়সী ছেলেরাও ভিড়ছে এই কারবারে। আর কাঁচা টাকা হাতে এলেই যাদের ঝাঁ চকচকে মোটর বাইক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরের পথেঘাটে।
পুলিশের এক অফিসারের দাবি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা যাঁরা সম্পত্তি আগলে একা থাকেন, তাঁদের দিকেই বেশি নজর জমি কারবারিদের। ভয় দেখানো তো বটেই, কাজ হাসিল না হলে খুন-জখমেও হাত কাঁপে না তাদের।
জমি-বাড়ির এমন লাগামছাড়া দাম বাড়া রুখতে কিছু কি করতে পারে সরকার? ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের জেলা সাব রেজিস্টার সুকান্ত মণ্ডল বলেন, ‘‘সরকার বিনামূল্যে সমস্ত রকম পরিষেবা দেওয়ার জন্য অনলাইনে জমির চরিত্র, মূল্য-সহ নথি দেখার ব্যবস্থা করেছে। কোন সম্পত্তির কী মূল্য হতে পারে, তা নির্ধারণের ব্যবস্থা এখন সকলেরই চোখের সামনে আছে। তা ছাড়াও আমরা আছি। প্রয়োজনে আমাদের কাছে আসুন। সব রকম ভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত।’’ বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাস বলেন, ‘‘পুলিশকে বলা হয়েছে, কোনও রকম হুমকি বরদাস্ত করা হবে না।’’
হুমকির উদাহরণ অনেক আছে। বসিরহাটের এক প্রবীণ দম্পত্তির কথাই ধরা যাক। দালালরা কিছু দিন ধরেই তাঁদের সম্পত্তি কেনার জন্য ঘুরঘুর করছিল। ওই দম্পতি জানালেন, ক’দিন আগেই বাড়িতে এসেছিল দালাল। জল খেতে চায়। চেয়ারে বসেই পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে রাখল টেবিলে। বলল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পকেটে থাকলে বসতে অসুবিধা হচ্ছে, তাই টেবিলে রাখলাম মাসিমা।’ সেই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকার একটা বান্ডিলও রাখে টেবিলে। বলে, জমিটা যেন তাদেরই হাতে দেওয়া হয়। পছন্দ মতো দাম দিতেও আপত্তি নেই। স্বভাবতই এই দৃশ্যের সাক্ষী থেকে ওই দম্পতি আর কথা বাড়ানোর সাহস করেননি। দাম নিয়ে দরাদরি তো দূরের কথা!
এই সব মানুষের মনে ভরসা জোগাতে পারবে কি প্রশাসন, কোটি টাকার এই প্রশ্নটাও এখন ঘুরছে বসিরহাটের বাতাসে।
(শেষ)