ফের দায়রা আদালতে গরহাজির উকিলেরা

অসহায়ের মতো আদালত চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বছর পঁয়ষট্টির পাঁচু নস্কর। প্রচন্ড দাবদাহ থেকে বাঁচতে তাঁর ভরসা একটি ভাঙা লেডিজ ছাতা। সরিষার কলাগাছিয়া থেকে এসেছেন ডায়মন্ড হারবারে। তাঁর কথায়, ‘‘আগে জানা ছিল না উকিলবাবুদের ধর্মঘট। এখন আবার দিন নিতে হবে মুহুরিবাবুর কাছ থেকে।’’

Advertisement

শান্তশ্রী মজুমদার

ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০২:০৪
Share:

অসহায়ের মতো আদালত চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বছর পঁয়ষট্টির পাঁচু নস্কর। প্রচন্ড দাবদাহ থেকে বাঁচতে তাঁর ভরসা একটি ভাঙা লেডিজ ছাতা। সরিষার কলাগাছিয়া থেকে এসেছেন ডায়মন্ড হারবারে। তাঁর কথায়, ‘‘আগে জানা ছিল না উকিলবাবুদের ধর্মঘট। এখন আবার দিন নিতে হবে মুহুরিবাবুর কাছ থেকে।’’

Advertisement

ডায়মন্ড হারবার দেওয়ানি আদালতে বার অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্তে দফায় দফায় কর্মবিরতি চলছে। যার জেরে যারপরনাই নাজেহাল বিচারপ্রার্থীরা। কোর্টের একমাত্র স্ট্যাম্প ভেন্ডরের সেরেস্তাতেও তালা ঝুলছে। আইনজীবীরা উপস্থিত না থাকায় কাজ করেনি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টও।

ডায়মন্ড হারবার মহকুমা ফৌজদারি আদালতে অবশ্য পুরো দস্তুর কাজকর্ম চলছে। কিন্তু দেওয়ানি আদালতের আইনজীবীরা বারবার ছুটি নিয়ে চলেছেন। মে মাসে দু’দফায় মোট আট দিন কাজ বন্ধ ছিল দেওয়ানি আদালতে। দেওয়ানি আইনজীবীদের সংগঠনের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফের কর্মবিরতি পালন করা হবে। সেই মতো ৮-১৫ জুন, অর্থাৎ আগামী সোমবার পর্যন্ত চলছে আট দিনের কর্মবিরতি।

Advertisement

এদিন আদালত চত্ত্বরে গিয়ে দেখা গেল, বার অ্যাসোসিশনের ঘর সহ সমস্ত উকিলদের সেরেস্তায় তালা। মুহুরিদের চেয়ারটেবিলও উল্টে তালা দেওয়া। ইতস্তত কয়েকজন বিচারপ্রার্থী ঘোরাফেরা করছেন। কোর্ট বন্ধ থাকার খবর না পেয়ে রোজই কোনও কোনও মক্কেল অনেকটা দূর থেকে এসে ফিরে যাচ্ছেন। হটুগঞ্জ থেকে এসেছিলেন সঞ্জয় মণ্ডল। উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘উকিলবাবুরা সুখী মানুষ, গরমে কাজ করতে পারেন না। আমরাই পারি দূর দূর থেকে ছুটে আসতে।’’ তিনিও মুহুরিকে ধরে পরের শুনানির দিন ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

কর্মবিরতির নমুনা অবশ্য আরও আছে ডায়মন্ড হারবার আদালতে। গত আট মাসের বেশি চলছে এক মহিলা বিচারকের এজলাস বয়কট। তাঁর বিরুদ্ধে আইনজীবীদের নানা অনৈতিক কাজের অভিযোগ রয়েছে। হাইকোর্ট তদন্ত করছে। দেড় দু’মাস থেকে চলছে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক অঞ্জলি সিংহের এজলাস বয়কট। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার এবং আইনজীবীদের সওয়ালের সময় না দেওয়ার অভিযোগ করেছেন আইনজীবীরা। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপেও যা এখনও মেটেনি। চারটি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের একটিতে বিচারক নেই। প্রতি মাসে রবিবার, দুটি করে শনিবার আদালত ছুটি থাকে। তারপরেও দফায় দফায় কাজ বন্ধ কেন? দেওয়ানি আদালতের আইনজীবীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই প্রচন্ড গরমে পাখার ব্লেড ঘুরছে না। তার উপর কালো জোব্বা পরে সওয়াল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাই মক্কেলদের অসুবিধা সত্ত্বেও এই রাস্তা নিতে হয়েছে তাঁদের। যদিও সংগঠনের পদাধিকারীরা সরাসরি কোনও কথা এ দিন বলতে চাননি। সিভিল কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক প্রদীপ বসু বলেন, ‘‘কর্মবিরতির বিষয়ে সোমবারের আগে কিছু বলব না।’’

ডায়মন্ড হারবার দেওয়ানি আদালতে মহকুমা দায়রা বিচারকের এজলাস ছাড়াও ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট এবং মুন্সেফ কোর্ট মিলিয়ে আরও ১০টি আদালত রয়েছে। রোজ রোজ প্রতিটি মামলায় আইনজীবীদের গরহাজিরার জন্য প্রচুর মামলা পিছিয়ে চলেছে। পাঁচ-ছয় মাসের আগে পরবর্তী শুনানির দিন পড়ছে না। অর্থাৎ, একটি মামলার দুটি শুনানিতেই বছর পার হয়ে যাচ্ছে।

আইনজীবীদের একটি অংশ দাবি করেন, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টে গরমের ছুটি থাকে। রাজ্যের নিম্ন আদালতগুলিতে তা নেই। এর আগে ২০০৪-০৫ সালে একবার নিম্ন আদালতে গরমের ছুটি চালু হলেও তা হাইকোর্টের নির্দেশেই পরে উঠে যায়। তাই প্রচন্ড গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে ডায়মন্ড হারবারে গ্রীষ্মে কর্মবিরতির এই রেওয়াজ পুরনো।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গরমে অন্য আদালত কাজ করতে পারলে দেওয়ানি আদালতই বা কাজ করবে না কেন? অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকের এজলাস-সহ কয়েকটি এজলাসে এদিনও ফৌজদারি মামলার শুনানি হয়েছে। কিন্তু প্রায় বসেই ছিলেন বাকি ১০টি আদালতের বিচারক এবং আদালত কর্মচারীরা। একটি মাত্র স্ট্যাম্প ভেন্ডর রয়েছেন। তারও সেরেস্তাও বন্ধ ছিল এদিন। কেন? ফৌজদারি মামলার কাজ যেখানে চলছে, সেখানে তো প্রতিনিয়ত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দরকার হতে পারে। ওই ভেন্ডর গৌর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, দেওয়ানি আদালতে আইনজীবীদের সংগঠনের নেতারা তালা দিয়ে চলে গিয়েছেন বলে তিনি তাঁর সেরেস্তা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অ্যাসোসিয়েশনের জায়গাতেই বসে আমি স্ট্যাম্প বিক্রি করি। সব দিক তালা দেওয়া বলে আমিও আর স্ট্যাম্প নিয়ে বসতে পারিনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন