হেলমেট থাকলে প্রাণটা তো বাঁচত

সে দিন যদি হেলমেটটা থাকত মাথায়... এখনও আফসোস যায়নি সন্তানহারা মায়ের!দিনটা এখনও ভুলতে পারেন না তিনি। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। বসিরহাটের বড় জিরাকপুর তরুণ সঙ্ঘ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল বসিরহাটের লক্ষণকাটি এলাকার তিন ছাত্র বাবুসোনা খাঁ, মসিউর রহমান মণ্ডল এবং মোস্তাক গাজির।

Advertisement

নির্মল বসু

বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ০২:৪৫
Share:

সে দিন যদি হেলমেটটা থাকত মাথায়... এখনও আফসোস যায়নি সন্তানহারা মায়ের!

Advertisement

দিনটা এখনও ভুলতে পারেন না তিনি। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। বসিরহাটের বড় জিরাকপুর তরুণ সঙ্ঘ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল বসিরহাটের লক্ষণকাটি এলাকার তিন ছাত্র বাবুসোনা খাঁ, মসিউর রহমান মণ্ডল এবং মোস্তাক গাজির। স্কুল থেকে অ্যাডমিট কার্ড পেয়েছিল সে দিনই। বছর ষোলো-সতেরোর তরতাজা কিশোর। সামনেই পরীক্ষা, সেই আনন্দে স্কুল থেকে বেরিয়ে সকলে যাচ্ছিল নতুন জামাকাপড়ের অর্ডার দিতে।

একই মোটর বাইকে চেপেছিল তিন বন্ধু। গাড়ি চালাচ্ছিল মসিউর। দণ্ডীরহাটে যাওয়ার রাস্তায় একটি বাসকে পাশ কাটাতে গিয়ে বাসের গায়ে সামান্য ধাক্কা লাগে বাইকের। খুব জোরে গাড়ি চলছিল না বলে জানা যায় পরে। কিন্তু চলন্ত বাইকটি তাতেই ছিটকে পড়ে। পিছন থেকে আসা একটি ট্রাক পিষে দেয় তিনজনকে।

Advertisement

ঘটনাস্থলেই মাথা ফেটে মারা যায় বাবুসোনা ও মসিউর। মোস্তাক বেঁচে যায় বরাতজোরে। মাস দেড়েক চিকিৎসার পরে আবার পড়াশোনা শুরু হয় তার। তবে বছরটা নষ্ট হয়। এখন সে পড়ছে একাদশ শ্রেণিতে। ছেলেটির কথায়, ‘‘এখনও চোখ বুজলে ওদের মুখগুলো ভেসে ওঠে। সে দিন আমার চোখের সামনেই ওদের মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে যেতে দেখেছি। ট্রাকের চাকা চলে যায় মাথার উপর দিয়েই। সে দিন যদি হেলমেট পরতাম আমরা সকলে, তা হলে ওদের এই দশা হতো না।’’

পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিল বাবুসোনা। তার মা সেরিনা বিবির চোখের জল এখনও শুকোয়নি। মঙ্গলবার বাড়িতে গিয়ে সেই প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, ‘‘সে দিন হেলমেট পরা থাকলে হয় তো প্রাণটা বাঁচত।’’ বাবুসোনার কাকা মুকুল খাঁয়ের কথায়, ‘‘সরকার হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করেছে, এটা খুবই ভাল কথা। অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ে বেঁচে যাবে। আমাদের যদি আগে এই সচেতনতা থাকত, তা হলে এত বড়ে বিপদ ঘটত না।’’ তাঁর আরও মত, এ ভাবে অল্পবয়সী ছেলেদের হাতে বাইক পরাটাই উচিত নয়।

মসিউরের বাবা মিজানুর রহমান মণ্ডলের চার ছেলেমেয়ে। মসিউরই ছিল বড়। মিজানুর বলেন, ‘‘ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। সব এক মূহূর্তে শেষ।’’ মা সুফিয়ার কথায়, ‘‘হেলমেট নিয়ে সরকার আগে কেন এমন কড়া পদক্ষেপ করল না। তা হলে তো আমাদের এমন বিপর্যয় ঘটত না।’’

ওই গ্রামেরই ছেলে ফারহাজ গাজি বলেন, ‘‘ওই ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষজন আরও সচেতন হয়েছেন। অল্পবয়সীরাও ধীরেসুস্থে গাড়ি চালায়। হেলমেট পরার অভ্যাসও হয়েছে অনেকের। কিন্তু দু’দু’টো প্রাণের বিনিময়ে এমন শিক্ষা পেতে হল। হেলমেট পরা নিয়ে একটু সচেতনতা থাকলে দুর্ঘটনাটা হয় তো প্রাণঘাতী হতো না।’’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক সজলকুমার দের মতে, সরকারি কর্মী বিশেষ, পুলিশকেও হেলমেট পরতে হবে। তা দেখে শিখবে ছোট ছোট ছেলেরা। তা ছাড়া, পরিবারগুলিকেও সচেতন হতে হবে। অল্পবয়সী ছেলেরা যাতে মোটরবাইক না চালায়, বাড়ির সকলে যেন হেলমেট অবশ্যই পরে, তা সকলকেই খেয়াল রাখতে হবে। তবে হেলমেট নিয়ে সরকারের উদ্যোগকে খোলা মনে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।

স্কুলের কৃতী ছেলেদের কথা বলতে বলতে এখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষক। বললেন, ‘‘ঘটনার দিন সকলকে গোলাপ ফুল দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পরীক্ষা ভাল করে দিতে হবে। এই ক’দিন পড়াশোনায় মন দিতে হবে। মোটর বাইক চালানো বন্ধ রাখতে হবে।’’ এত সব কথা শুনে স্কুলে থেকে বেরিয়েই দুর্ঘটনায় পড়ল ছাত্রেরা— আক্ষেপটা থেকেই যাচ্ছে সজলবাবুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন