শৌচালয়ের সামনে লাইন। ছবি: সুজিত দুয়ারি
গোটা এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে রয়েছে শৌচাগার। সরকারি প্রকল্পে বেশির ভাগ পরিবারই এখনও পাকা বাড়ি পাননি। রয়েছে পানীয় জলের সমস্যাও।
বহু বছর ধরে তাঁরা পুরসভা এলাকায় বসবাস করলেও সমস্ত রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ। এঁরা সকলেই অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাইগাছি এলাকার সর্দারপাড়ার বাসিন্দা। এখানে সব মিলিয়ে পরিবারের সংখ্যা শতাধিক। বেশির ভাগই আদিবাসী পরিবার।
পুরসভা ভোট হোক বা লোকসভা— প্রতিটি ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলির তরফে আদিবাসী মানুষকে গালভরা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। প্রতিবারই মানুষ এই প্রত্যাশা নিয়ে ভোটের লাইনে দাঁড়ান, এ বার হয় তো ভোট শেষে তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। বাস্তবে অবশ্য তেমনটা হয় না। সামনেই লোকসভা ভোট। এলাকাবাসী রোজনামচায় উঠে আসছে বঞ্চনার সাতকাহন।
ভোটের কথা তুলতেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন বাসিন্দারা। মনিকা সর্দার উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘‘এ বার আর আমাদের ভোট নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। সরকারি প্রকল্পে পাকা ঘর পাইনি, শৌচাগার পাইনি। পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। এরপর আর আমরা ভোট নিয়ে ভাবতে রাজি নই।’’ রত্না মুন্ডা বলেন, ‘‘ভোটের সময়ে এলাকায় এসে নেতারা বলেন, আমাদের এই দেবেন, ওই দেবেন। ভোট মিটে গেলে আর কেউ আসেন না আমাদের কেউ দেখেনও না।’’ বৃদ্ধ শ্যাম মুন্ডার কথায়, ‘‘নেতারা শুধু নিতেই আসেন। আমাদের কিছু দিচ্ছেন না। চোখের সামনে দেখি, ভাল বাড়ি ভেঙে সরকারি পাকা বাড়ি হচ্ছে। অথচ আমাদের ভাঙাচোরা বাড়িঘর আর পাকা হয় না।’’
এলাকার বাসিন্দারা মূলত খেতমজুরি, দিনমজুরি করেন। অনেকে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন কাজের খোঁজে। এলাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বেশির ভাগই মাটির বাড়ি। পলিথিন দিয়ে ঘেরা ঘরও রয়েছে। বাসিন্দারা জানান, মাত্র তিনটি পরিবার এখনও পর্যন্ত সরকারি প্রকল্পে পাকা বাড়ির অনুমোদন পেয়েছে।
স্থানীয় একটি সাংস্কৃতিক সাংস্কৃতিক সংস্থার তরফে দু’টি শৌচাগার ও একটি স্নানঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ভোর রাত থেকে ওই দু’টি শৌচাগারের সামনে মহিলা-পুরুষের দীর্ঘ লাইন পড়ে। মামনি মুন্ডা বলেন, ‘‘অনেকে মাঠেঘাটে যেতে বাধ্য হন। লজ্জা লাগে। শৌচাগারের সামনে আমাদের রেশন দোকানের মতো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’’
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাত্র ২০টি পরিবারে পাকা শৌচালয় রয়েছে। যাঁদের শৌচালয় রয়েছে, তাঁদের আবার জলের সমস্যা। এক মহিলা বলেন, ‘‘ভোরে অন্ধকার থাকতে অনেকেই ঘুম থেকে উঠে মাঠে গিয়ে শৌচকর্ম সেরে আসি।’’ বাড়িঘরের এমন ভাঙাচোরা দশা, জোরে হাওয়া দিলেও বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন। বৃষ্টি শুরু হলে অনেকেই ভয়ে সাংস্কৃতিক সংস্থার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন।
রয়েছে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল ও জমা জল নিকাশির সমস্যা। এক বৃদ্ধ হতাশ হয়ে বলেন, ‘‘ভোটের সময় ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের এখানে দেখা মেলে না। একবার এক জনপ্রতিনিধি এলাকার বাইরের রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। আমরা তাঁর গাড়ি আটকাই। বসিয়ে চা খাইয়ে অনুরোধ করেছিলাম, আমাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করে দিতে। উনি কথা দিয়েছিলেন। তারপরেও বহু দিন কেটে গিয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।’’ বাসিন্দারা জানান, বাম ও তৃণমূল সরকার কেউই কিছু করেননি। এ বার তাঁরা ভোট দেবেন কিনা তা নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
স্থানীয় কাউন্সিলর তৃণমূলের সিদ্ধার্থ সরকার বলেন, ‘‘ওঁদের উন্নয়নে আমরা সব সময়ে সচেষ্ট। অনেকেরই জমি-বাড়ির দলিল নেই। ফলে সরকারি নিয়মে আটকে যায়। অনেককেই সরকারি প্রকল্পে বাড়ি দেওয়া হয়েছে। অনেকে সে জন্য আবেদন করেননি।’’ শৌচাগার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও তাঁর দাবি।
অশোকনগরের বিধায়ক ধীমান রায় অবশ্য বলেন, ‘‘সকলেই দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করেন। শোচনীয় পরিস্থিতি। সমস্যা হচ্ছে, অনেকেরই ভোটার তালিকায় নাম নেই। আমরা চেষ্টা করছি সকলকে বাড়ি ও শৌচাগার তৈরি করে দিতে।’’