মেরেছো কলসির কানা, তা বলে কি...

যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠেও চ্যালাকাঠ দিয়ে সাপটাকে চেপে ধরেন বাপি। বাড়ির লোকজন যখন তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার তাড়া করছেন, তখন বাপি ব্যস্ত সাপটাকে ধরে বালতিতে ভরতে। গোঁ ধরেছেন, সাপকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হবে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

হাবরা শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:২০
Share:

বাপি ব্যাপারি— ছবি: শান্তনু হালদার

হঠাৎ উপর থেকে পায়ের কাছে খসে পড়েছিল বিষাক্ত সাপ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোবল মারে।

Advertisement

যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠেও চ্যালাকাঠ দিয়ে সাপটাকে চেপে ধরেন বাপি। বাড়ির লোকজন যখন তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার তাড়া করছেন, তখন বাপি ব্যস্ত সাপটাকে ধরে বালতিতে ভরতে। গোঁ ধরেছেন, সাপকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হবে। তাতে চিকিৎসার সুবিধা হবে। সাপ কী প্রজাতির, কতটা বিষাক্ত, আদৌ বিষধর কিনা— সে সব বুঝলে চিকিৎসকেরা ঠিক মতো ওষুধ দিতে পারবেন।

সোমবার হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে প্লাস্টিকের প্যাকটে ভর্তি সাপ নিয়ে হাজির হয়ে বাপি এ যাত্রা বেঁচে গিয়েছেন। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতেও বার বার সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, সাপটার কোনও ক্ষতি যেন কেউ না করে। মঙ্গলবার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন বাপি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাছাকাছি জঙ্গলে ছেড়ে এসেছেন সাপটিকে।

Advertisement

সাপের ছোবল খেলে

শান্ত থাকুন। উত্তেজিত অবস্থায় শরীরে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। তাতে শরীরে বিষও তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। হাঁটাচলা, দৌড়োদৌড়ি বারণ।

কোনও খাবার-পানীয় নেওয়া চলবে না। তাতে শরীরে মেটাবলিজম বেড়ে যায়। রক্ত সঞ্চালনা দ্রুত হয়ে শরীরে বিষ আরও তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে।

যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিষাক্ত সাপে ছোবল মারলে অ্যান্টিভেনম ওষুধই একমাত্র বাঁচার পথ। (ছবিতে, বাপি ব্যাপারি)

নিজে সাপের ছোবল খেয়েও সেই সাপকে বাঁচিয়ে বাপি ব্যাপারি এখন উত্তর হাবরার নট্টপাড়া গলির হিরো। সুপুরি, নারকেলের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বছর তিরিশের যুবক। সাপের প্রতি এত দরদ এল কোথা থেকে?

জানা গেল, সময় পেলেই ডিসকভারি, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটের মতো চ্যানেলে নজর রাখেন বাপি। বন্যপ্রাণ নিয়ে অনুষ্ঠান তাঁর পছন্দের। বিষাক্ত সাপেদের নিয়ে নানা সময়ে অনুষ্ঠান দেখে বাপি বুঝেছেন, তারা কেউ ইচ্ছা করে কাউকে কামড়ায় না। নেহাতই ভয় পেলে বা আত্মরক্ষা করতেই ছোবলের আশ্রয় নেয়। আর এটাও জেনেছেন, সাপকে বাঁচিয়ে রাখা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে কতটা জরুরি। সেই শিক্ষা কাজে এসেছে বিপদের মুহূর্তেও।

সোমবার সকালে বাড়ির রান্নাঘর সাফসুতরো করছিলেন বাপি। চোখে পড়েনি, বাঁশের আড়া থেকে ঝুলে রয়েছে হাত দু’য়েক লম্বা শাঁখামুটে সাপ। হঠাৎই উপর থেকে পড়ে সাপটি পায়ে ছোবল মারে। বাপির কথায়, ‘‘চোখের সামনে ছোবল মারল দেখে প্রথমটায় ঘাবড়ে যাই। প্রাণটা যেন গলার কাছে আটকে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্যই। তারপরে মনে পড়ল, টিভিতে সাপ ধরার দৃশ্য। মনে হল, বাঁচতে হলে সাপটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি।’’

টিভি দেখে শেখা কৌশল কাজে আসে। চ্যালা কাঠ দিয়ে সাপের পিঠের কাছটা চেপে ধরেন বাপি। ফণা তুলছিল সাপ। ততক্ষণে বাপির চিৎকারে লোক জড়ো হয়েছে। বাড়ির মেয়েরা এসে বাপির কথা মতোই তাঁর পায়ে দড়ি দিয়ে তিনটে বাঁধন দেন। সাপটা কাঠের টুকরোটা পেঁচিয়ে ধরেছিল। ওই সুদ্ধ বালতির মধ্যে রাখেন বাপি। সাপটাকে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে ওঠেন টোটোতে। পৌঁছন হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানান, সাপটি বিষাক্ত। সেই মতো শুরু হয় শুশ্রূষা।

মঙ্গলবার বাড়িতে পৌঁছলেও এখনও গায়ে ব্যথা আছে। ঘুম ঘুম ভাব। কিন্তু পাড়ার লোকজনকে সাপ ধরার গল্প করতে হচ্ছে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আগে কখনও সাপ ধরেছেন? কস্মিনকালেও নয়, জানালেন বাপিবাবু। শুধু টিভি দেখার বিদ্যেটুকুই ছিল ভরসা। আর ছিল বিপদের মুহূর্তেও মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা। সাপ মারা অনুচিত, ছিল এই বোধটুকুও। বাপি বলেন, ‘‘জীবজন্তু-পাখি কাউকে কখনও মারি না। সকলেই তো আমাদের এই পরিবেশের অংশ।’’

সাপ ধরার কৌশল বাপি ঠিকঠাকই শিখেছেন। কিন্তু সাপ ধরে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছনোও কী জরুরি?

সে কথা অবশ্য মানছেন না চিকিৎসকেরা। হাবরা হাসপাতালের সুপার শঙ্করলাল ঘোষ বলেন, ‘‘ক্ষত দেখেই আমরা বুঝতে পারি, সাপটি বিষধর কিনা। সাপ ধরার সময়টুকু নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে আসা বেশি জরুরি।’’— ছবি: শান্তনু হালদার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন