দুই বাংলার মিলনেই সম্পূর্ণ মতুয়া মেলা

দশ বছর পরে দেখা। ছেলেরা যখন প্রাণপণ শক্তি আর আবেগে ডঙ্কা-কাঁসি বাজাচ্ছে, দুই দলপতি তখন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুধুই কাঁদছেন। বাংলাদেশের যশোরের শার্সার দিগম্বর মণ্ডলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ভাগ্নে সীতারামের। “কতবড় হয়ে গেছিস” চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিলেন দিগম্বর।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

ঠাকুরনগর শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০২:৪৫
Share:

মেলার আনন্দে মাতোয়ারা ভক্তেরা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

দশ বছর পরে দেখা।

Advertisement

ছেলেরা যখন প্রাণপণ শক্তি আর আবেগে ডঙ্কা-কাঁসি বাজাচ্ছে, দুই দলপতি তখন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুধুই কাঁদছেন। বাংলাদেশের যশোরের শার্সার দিগম্বর মণ্ডলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ভাগ্নে সীতারামের। “কতবড় হয়ে গেছিস” চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিলেন দিগম্বর।

মেলা মানে যদি ‘মিলন’ হয়, তা হলে দেশ ভাগের পরে বাংলাদেশ থেকে এ দেশে আসা ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে সারা বছরে একবার যোগাযোগের সূত্র হল ঠাকুরনগরে মতুয়া ধর্ম মহামেলা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ৮০-১০০ জনের ছোট ছোট দল ম্যাটাডর বা বাস নিয়ে আসছে বেনাপোল সীমান্তে। মতুয়া মেলার জন্য শিথিল হয়েছে সীমান্তের কড়াকড়ি। বিজিবি এবং বিএসএফ গাড়িকে জামিনদার হিসাবে রেখে মাথা গুণে পেট্রাপোলে ঢুকতে দিচ্ছে। আবার গুণে গুণেই ফিরে যাচ্ছে সকলে।

Advertisement

মঙ্গলবার সকাল থেকেই ঠাকুরনগরের গোটা আকাশটা লাল। উপরের দিকে তাকালেই শুধু চোখে পড়ছে মতুয়াদের লাল ত্রিকোণ নিশান। বাতাশে শুধুই বাদ্যির শব্দ। শুধু ঠাকুরনগর কেন, গোটা গাইঘাটা ও আশপাশের এলাকায় বাস্তবিক অর্থেই যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষের ভিড়ে প্রশাসনের তরফেই বন্ধ করা হয়েছে সমস্ত যানবাহন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত, উত্তরবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা থেকে দলে দলে ভক্তরা যশোর রোড ধরে সারি দিয়ে আসছেন। ভিড়ে ঠাসা ট্রেন পৌঁছচ্ছে ঠাকুরনগরে। সেখান থেকে ঠাকুরবাড়ি।

হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের বিশাল বিশাল তোরণ, জলসত্র আর রাস্তার পাশে তাঁবু-শামিয়ানার ছাউনি দেখলেই বোঝা যাবে ঠাকুরনগর এসে গিয়েছে। বিশাল মাঠের এক এক কোণায় আস্তানা গেড়েছে এক একটি দল। সেখানে খাওয়া-দাওয়া আর কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়েই নাচের তালে তালে ভক্তেরা ঢুকে পড়ছে শহরে। শিলিগুড়ির মাটিগাড়ার বৃদ্ধা অর্ধসতী মণ্ডল কপালে হাত জড়ো করে বলেন, “কোথায় কষ্ট? সারাটা বছর তো এই দিনটার জন্যই অপেক্ষায় থাকি। জানি না, সামনের বছর আর আসতে পারব কিনা।”

মেলা কমিটির ব্যবস্থাপনায় তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা তো আছেই। তা ছাড়া, চেনা-অচেনা কোনও বাড়িতে ঢুকে পড়লেই হল। এলাকার মানুষ সাগ্রহে সদরে দাঁড়িয়ে আছেন অভ্যর্থনায়। মৃণালকান্তি বিশ্বাসের বাড়ি-ঘর, উঠোন, পুকুরপাড় ভরে গিয়েছে অতিথিতে। এঁদের কেউই আত্মীয় নন। পরিচিতও নন অনেকে। কেউ কেউ আবার প্রতিবারই এসে এই বাড়িতেই ওঠেন। তাঁদের সঙ্গী হয়ে প্রতিবারই অতিথির সংখ্যাটা বেড়ে চলে। হাসিমুখে সকলের সেবায় হাজির মৃণালবাবু আর তাঁর পুরো পরিবার।

মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল, অতিথিরা দাওয়ার মাটি খুঁড়ে উনুন বানিয়ে রান্না করছেন। গত একমাস ধরে বাড়ির গাছের শুকনো ডাল-পাতা জড়ো করে রেখেছেন মৃণালবাবুরা। অতিথিরা সেই জ্বালানিই ব্যবহার করছেন। বাড়ির দাওয়ার ত্রিপল পেতে কেজি-টু’য়ের ছোট্ট কুশলকে কোলে নিয়ে মুড়ি-আলুমাখা খাওয়াচ্ছিলেন বহরমপুরের মাছ ব্যবসায়ী পরেশনাথ মণ্ডল। পাশে নতুন শাড়ি পড়ে ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন স্ত্রী ঝুমাদেবী। এত দূর থেকে এসেছেন। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো? পরেশবাবু এক গাল হেসে বললেন, “অসুবিধা একটু হচ্ছে না বলব না। মুর্শিদাবাদের কাশীমবাজার পর্যন্ত হেঁটে তারপর ট্রেন ধরে রানাঘাট হয়ে এসেছি বনগাঁয়। সেখান থেকে ট্রেন ধরে ঠাকুরনগর। ফের হাঁটা।” এত কষ্ট করে আসেন? পরেশবাবুর জবাব, “কোনও সংস্কার নয়, আনন্দ পাই বলেই আসি।”

মৃণালবাবুর মেয়ে অর্জমা বিশ্বাস একবার ছুটে বেড়াচ্ছে। কখনও তার দায়িত্ব নদিয়ার এক দিদার পানের জন্য চুন আনা। পরক্ষণেই হাঁক পড়ছে মালদহের অমুক কাকুর জন্য দেশলাই জোগাড়ের। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। অর্জমা বলে, “সকলেই এটা-ওটা চায়। তাঁদের হাতে সে সব তুলে দিতে পারলে ভাল লাগে।” হাসতে হাসতে মেয়েটি বলে, “পরীক্ষা ভালই হবে। এ ক’দিন এমন চলবে বলে আগে থেকেই পড়া সেরে রেখেছি।”

অর্জমাদের বাড়ির সামনেই রাস্তার পাশে নানা রকমের দোকান। একটি হোটেলে ঝুলছে পিচবোর্ড। তাতে আলতা দিয়ে লেখা, নিরামিষ ভাত ৩০ টাকা, ডিম ভাত ৪০ টাকা। বহরমপুরের তিন বন্ধু দুর্লভ বাইন, রেবতী বিশ্বাস এবং রণি মণ্ডল দোকান দিয়েছেন। দুপুরের মধ্যেই শ’তিনেক মানুষ খাওয়া-দাওয়া করেছেন। দুর্লভবাবু বলেন, “আমরা তিন বন্ধু প্রতিবার এসে এ ভাবেই হোটেল দিই। বেচাকেনা ঠাকুরবাড়ির কামনাসাগরে ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। এই যা কিছু আছে, টেবিল, বেঞ্চি, মালপত্র এমন কী, বিস্কুটের জারগুলিও ঠাকুরনগর থেকে কেনা।” দুর্লভবাবুদের মতো সাময়িক হোটেলগুলিকে এই ক’দিনের জন্য কাচের জার ভাড়া দেন ছোটকা। বললেন, “এ বার সাড়ে চারশো জার ভাড়া দিয়েছি।”

মেলাকে ঘিরে নানা মানুষের নানা রোজগারপাতি হয়। নবম শ্রেণির শুভ বিশ্বাস ও তার দিদি দীপারা বাতাসার দোকান দিয়েছে। লাল পাড় শাড়ি, সুন্দর করে চুল বেঁধে ঠাকুরবাড়ির রোয়াকে বসে দীপা। সে বলে, “মেলায় অনেক বেচাকেনা হয়। সংসারের কাজে লাগে।” মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ধ্যানেশ গুহর কথায়, “এই মন্দার বাজারে এই অর্থনীতিও কম কী সে?”

আবেগের বাঁধনহারা চেহারা গোটা ঠাকুরনগর জুড়ে। চলছে উদ্দাম নাচ। একটি দল যখন মুখোমুখি হচ্ছে অন্য দলের, চলছে ডাঙ্কা বাজানোর প্রতিযোগিতা। বাতাসার লুঠ দেওয়া হচ্ছে ঘন ঘন। পবিত্র প্রসাদ মনে করে সেই বাতাসা কুড়িয়ে নিচ্ছেন ভক্তরা। ঠাকুর বাড়িতে ঢুকেই কেউ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন। গদি ঘরে বসে বড়মার ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ। বীণাপাণিদেবীর পাশেই বসে ঠাকুরবাড়ির বড় বৌ, সদ্য সাংসদ মমতা ঠাকুর। সেখানে লম্বা লাইন। ভক্তদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন দু’জনেই। মমতা বলেন, “মানুষের বাঁধনহারা আবেগ, ভালবাসা, আনন্দ এর থেকে সুন্দর আর কী আছে? এখনও প্রচুর মানুষ পথে আছেন। তাঁরা আসছেন।”

আজ, বুধবার ভোর থেকে কামনাসাগরে শুরু হবে পুণ্যস্নান। গোটা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগ সামাল দিতে তৈরি ঠাকুরনগর। সব প্রস্তুতি সারা, জানাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনও।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন