ছেলেকে চোখের আড়াল করতে নারাজ মাজেদা

দিন সাতেক আগে জন্ম হয়েছিল তার। জন্মানোর পরে মায়ের বিছানায় কিংবা কোলে জায়গা হয়নি। ঠাঁই হয়েছিল কাচের একটি পাত্রে। সেখান থেকেই হয়তো পাচার হয়ে যেত সে। কিন্তু তা না হয়ে শনিবার মা মাজেদা বিবি ও বাবা আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে সে ফিরল বসিরহাটের নেহালপুর গ্রামের বাড়িতে। সৌজন্যে সিআইডি।

Advertisement

নির্মল বসু

বসিরহাট শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৫১
Share:

মায়ের আদর। নিজস্ব চিত্র।

দিন সাতেক আগে জন্ম হয়েছিল তার। জন্মানোর পরে মায়ের বিছানায় কিংবা কোলে জায়গা হয়নি। ঠাঁই হয়েছিল কাচের একটি পাত্রে।

Advertisement

সেখান থেকেই হয়তো পাচার হয়ে যেত সে। কিন্তু তা না হয়ে শনিবার মা মাজেদা বিবি ও বাবা আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে সে ফিরল বসিরহাটের নেহালপুর গ্রামের বাড়িতে। সৌজন্যে সিআইডি।

বাবা মা তার নাম রেখেছে শেখ মফিজুল। ছোট্ট মফিজুল বাড়ি ফেরাতে খুশি পরিবার থেকে প্রতিবেশীরা। রবিবার সকাল থেকেই প্রতিবেশীরা বাড়ির সামনে ভিড় করছেন মফিজুলকে দেখতে। কেউ হাতে খেলনা নিয়ে আসছেন আবার কেউ দোয়া দিয়ে যাচ্ছেন।

Advertisement

তৃতীয় সন্তান মফিজুলকে বুকে জড়িয়ে মাজেদা বলেন, ‘‘সেই রাতের কথা আজও ভুলতে পারছি না। সিআইডি কাকুদের জন্যই বাচ্চাটাকে ফিরে পেলাম। সময় মতো ওনারা নার্সিংহোমে না পৌঁছলে হয়তো এ-ও বিক্রি হয়ে যেত।’’

দরমার দেওয়ালের উপর টালির চালের ঘর আব্দুরের। ৭ ছেলে ২ মেয়ে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মাজেদা বাপের বাড়ি বাদুড়িয়ার জঙ্গলপুর গ্রামে। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর মাজেদা বাপের বাড়ি চলে যান। ২১ নভেম্বর বাদুড়িয়ার বাগজোলায় সোহান নার্সিংহোমে চিকিৎসক তপনকুমার বিশ্বাসের অধীনে ভর্তি হন মাজেদা। কথা ছিল অপারেশনের জন্য খরচ লাগবে ১০ হাজার টাকা। অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল।

মাজেদা বিবি জানান, বড় একটা ঘরে মাজেদা বিবিকে একাই ভর্তি নেওয়া হয়েছিল। ওই দিন সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ অস্ত্রোপচার করে মফিজুল হয়। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমে বাচ্চা না দেখলেও তার কান্না শুনেছিলাম। তাকে একটি কাঁচ দিয়ে ঘেরা জায়গাতে রাখা হয়েছিল দেখেওছিলাম। তারপর আমাকে ইঞ্জেকশন দেওয়ায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি।’’

রাত ৭টা নাগাদ ঘুম ভাঙে মাজেদার। নার্সিংহোমে তখন ছোটাছুটি হচ্ছে। পাশে তাঁর শিশুটিও নেই। হঠাৎ তাঁর ঘরে ঢোকে সিআইডি-র দল। সিআইডি-র পক্ষ থেকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘‘সন্তান কোথায়?’’ কোনওরকমে ঘরের এককোণে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন মাজেদা। কিন্তু সেখান থেকে পাওয়া যায়নি মফিজুলকে। সিআইডি-র দল পাশের একটি ঘর থেকে ওই শিশুকে উদ্ধার করে মাজেদার কোলে তুলে দেন। একটি গাড়ি ঠিক করে তাতে শিশু-সহ মাজেদাকে পাঠানো হয় পাশের একটি নার্সিংহোমে।

এ দিকে পুলিশের ফোন পেয়ে সেখানে পৌঁছয় মাজেদার পরিবার। পাশের একটি নার্সিংহোমে কিছুক্ষণ রাখা মাজেদাদের।

চিকিৎসকের অভাবে সেখানে রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। এরপরেই আব্দুর তাঁদের নিয়ে ছোটেন রুদ্রপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। শিশু এবং মায়ের শারীরিক অবস্থা তখন বেশ খারাপ। সেখান থেকে চিকিৎসকেরা মা ও শিশুকে বারাসত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। সেখান থেকে সুস্থ করে শনিবার বিকেলে সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন আব্দুর।

কিন্তু এখনও সেই রাতের আতঙ্ক কাটেনি স্বামী-স্ত্রীর চোখে। পেশায় ঝুড়ি বোনা আব্দুরের কথায়, ‘‘সন্ধ্যায় পুলিশের ফোন পেয়ে বুক কেঁপে উঠেছিল। কী দেখব নার্সিংহোমে গিয়ে তা বুঝতে পারছিলাম না। এরপর নার্সিংহোমে গিয়ে শুনি শিশু পাচারের গল্প। শুনলাম বিস্কুটের বাক্সে উদ্ধার শিশু। সে সব দৃশ্য আজও ভোলার নয়।’’

তবে মফিজুলকে এখন আর কোনও ভাবেই কাছছাড়া করছেন না মাজেদা। মফিজুল তাঁর কাছে ফিরে এসেছে ঠিকই। কিন্তু অনেক মায়েদের কোলই শূন্য হয়েছে ওই নার্সিংহোমে। যারা শিশু পাচার কাণ্ডে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান ওই দম্পতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন