মাঠের উপর দিয়ে দু’কিলোমিটার গিয়েছে হুকিংয়ের তার। নিজস্ব চিত্র।
বাড়িতে গিয়ে পাওয়া গেল না কৌতলার সেলাই মিস্ত্রি নাসির হালদারকে। এলাকায় সকলেই একডাকে চেনে তাঁকে। তাঁর কাছে কাজ করেন ৫-৭ জন শ্রমিক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মোবাইল চার্জ দিতে গিয়েছেন পাশের গ্রামে।
শুধু নাসিরই নন, এলাকায় মোবাইল ব্যবহার করেন এ রকম সকলকেই এখন হয় পাশের গ্রাম, না হয় একটু দূরে বাসে করে গিয়ে মোবাইল চার্জ দিয়ে আসছেন। কেন না এলাকায় বিদ্যুৎ দেওয়া হবে বলে বলা হলেও সেই কাজ হয়নি গত ২৫ বছরে। তাই এ বছর নির্বাচনে নেতাদের ফাঁকা বুলি আর শুনতে চান না এলাকাবাসী। যদিও কুলপির বিদায়ী বিধায়ক যোগরঞ্জন হালদার দাবি করছেন, ঠিকাদারের লোকজনকে মারধর করা হয়েছিল বলে কাজ হয়নি।
ঢোলাহাট থানার কৌতলায় রয়েছে ৪টি গ্রাম। হাজার পাঁচেক ভোটার। তৃণমূল ছাড়া বিরোধীদের বিশেষ দেখা মেলে না। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এখানে বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করা যায়নি। বিশ বছর আগে বাম আমলে বসানো একটি ট্রান্সফর্মার দিয়েই ওই সব মানুষের প্রয়োজন মেটাতে হয়। কিন্তু সেটুকুই। তারপর খুঁটি পোঁতা হলেও বিদ্যুৎ আসেনি। এখনও ওই ট্রান্সফর্মার থেকেই হুকিং চলে। ঢোলা পঞ্চায়েতের দক্ষিণ এবং মধ্য কৌতলার কিছু বাড়িতে প্রায় ২ কিলোমিটার পর্যন্ত ধানের জমির উপর দিয়ে হুকিংয়ের তার গিয়েছে খেজুরগাছ আর বাঁশে ভর করে। কিন্তু এতে বিপদের ঝুঁকি বাড়ে।
এলাকায় বিরোধী দল নেই। কিন্তু শাসক দলেরই একটি অংশ নেমেছে এর প্রতিবাদে। কৌতলার তৃণমূল নেতা বাপী নস্কর বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন আগে কিছু বিদ্যুতের খুঁটি পোঁতা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ আসেনি। দক্ষিণ কৌতলার একটি অংশে একটি লাইন রয়েছে, তবে তা নিতান্তই কম। ভোল্টেজের সমস্যা আছে। বিদায়ী বিধায়ক কিছু দিন আগেও এসে বলেছিলেন, কাজ হয়ে যাবে।’’ চারটির মধ্যে একটি বুথ থেকে নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যা ভবানী নস্কর বলেন, ‘‘এ রকম গ্রাম আমরা কেউই দেখিনি। প্রায় কুড়ি বছর ধরে বিদ্যুতের সমস্যা চলছে। বহুবার নেতাদের বলা হলেও সমস্যা মেটেনি।’’
নবম শ্রেণির ছাত্র মনিয়েম মোল্লা জানায়, কেরোসিনের আলোয় বেশিক্ষণ পড়তে কষ্ট হয়। একই কথা জানিয়েছেন, ঢোলাহাট কলেজের এক ছাত্রী। পড়াশোনা বাইরেও গ্রামের মানুষের জীবিকার একটি বড় অংশ নির্ভর করে বিদ্যুতের উপরে। কেন না, চুড়িদার, ব্লাউজ সেলাইয়ের কারখানা খুলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন কিছু বেকার যুবক। তাঁদের মধ্যে মজিদ, ইমরানরা জানান, এক মাস হল ট্রান্সফর্মার খারাপ। সেখান থেকেই বিদ্যুৎ নিয়ে চলছিল। এখন আর কাজ করতে পারা যাচ্ছে না। যেটুকু আশা ছিল, তা-ও গিয়েছে।
মাঝে মধ্যে খারাপ হলেও সারা বছরই টিমটিম করে কাজ চালিয়ে দেয় ওই ট্রান্সফর্মাররটিই। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছে, ভোট ঘোষণা হওয়ার পরে। এখন আর তা সারানোও হচ্ছে না। ফলে বিপদে পড়েছেন এলাকার মানুষ। সমস্যা আছে আরও। তবে খারাপ রাস্তা, জবকার্ড না পাওয়া এবং ছেলের স্কলারশিপের টাকা না পাওয়ার চেয়েও বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুৎ। নাসিরের মতো কিছু মানুষ কৌতলা লাগোয়া লক্ষ্মীনারায়ণপুরের দিকে থাকেন। তাঁদের মিটার রয়েছে, টাকাও দেন। কিন্তু পরিষেবার এই হাল।
এলাকার প্রবীণ মানুষ সিরাজ হোসেন হালদার বলেন, ‘‘গ্রামের সব পেশার মানুষ ঠিক করেছেন, ভোট দিতে বুথে গেলেও এ বার কোনও প্রার্থীর হয়েই বোতাম চাপা হবে না।’’ তা হলে কি এ বার এখানকার সব ভোট নোটায় পড়বে? আর কোনও জবাব পাওয়া গেল না।
যোগরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘কাজ করতে গিয়েছিল কন্ট্রাক্টর। তাঁদের লোকজনকে গ্রামবাসীরা মারধর করে কাজ আটকে দেয় বলে আর হয়ে ওঠেনি। তবে ওয়ার্ক অর্ডার হয়েছে। শীঘ্রই কাজ হবে।’’
আশ্চর্যজনক ভাবে কিছু দিন আগেও একই রকমের বিক্ষোভে নেমেছিলেন জগদীশপুর এলাকার মানুষ। রাস্তার কাজ হয়নি বলে। তখনও ঠিক একই ভাবে ঠিকাদারদের লোকজনকে পেটানোর অভিযোগ তুলে দায় ঝেড়েছিলেন যোগরঞ্জনবাবু।
এলাকার বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতারা বলছেন, না হওয়া কাজের কথা উঠলেই এখন বিধায়ক এই যুক্তি দিচ্ছেন। অথচ লক্ষ্ণীনারায়ণপুর থেকে কৌতলা পর্যন্ত রাস্তা এতটাই খারাপ যে, উনি প্রচারে এলে এই পর্যন্ত আসতেও পারেন না।