‘আবার দেখা যদি হল সখা’

কেউ প্রিয়জন হারিয়েছেন, কেউবা স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে এসেছেন। কারওর ঠিকানা লক্ষ্ণৌ, কারওর বা জবলপুর। শুধু এই একটা দিনের জন্যই তাঁরা এসেছেন পিকনিকে যোগ দিতে।

Advertisement

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৪৯
Share:

সবে-মিলি: ইছাপুরে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

শীতের দুপুর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নিস্তরঙ্গ গঙ্গা। ওঁরা নাচছেন।

Advertisement

কেউ প্রিয়জন হারিয়েছেন, কেউবা স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে এসেছেন। কারওর ঠিকানা লক্ষ্ণৌ, কারওর বা জবলপুর। শুধু এই একটা দিনের জন্যই তাঁরা এসেছেন পিকনিকে যোগ দিতে। তবে ওঁরা বলছেন, ‘‘পিকনিকটা তো বাহানা মাত্র। এত দিন পরে আবার সবার সঙ্গে দেখা হল। জীবনের পড়ন্তবেলায় এটা অনেকটা অক্সিজেন যোগাবে।’’

ওঁরা ইছাপুর রাইফেল কারখানা এবং ইছাপুর মেটাল অ্যান্ড স্টিল কারখানার প্রাক্তন কর্মী। কিন্তু বছর চল্লিশ তাঁদের কারওর সঙ্গে দেখা নেই। ১৯৭২ সালে তাঁরা শিক্ষানবিস হিসেবে ঢুকেছিলেন দুটি কেন্দ্রীয় সংস্থায়। পরে কেউ বদলি হয়ে গিয়েছিলেন ভিন রাজ্যে, কেউ বা অন্য সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন। সকলকে খুঁজে পাওয়াটা সহজ ছিল না। জনাকয়েক বৃদ্ধ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। শুক্রবার ইছাপুরের মেটাল ও স্টিল কারখানার মাঠে পুনর্মিলন পিকনিকে এসে কয়েকটা ঘণ্টার জন্য তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন সব বেদনা।

Advertisement

এই পিকনিকের অন্যতম উদ্যোক্তা শোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ইছাপুর নবাবগঞ্জের বাসিন্দা। তিনি নিজেও ইছাপুরের কারখানা থেকে বদলি হয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। অবসরের পর ফের ফিরেছেন সাবেক সাকিনে। এমন পুনর্মিলন উৎসবের পরিকল্পনা কী করে হল? তিনি বলেন, কাছাকাছি আমরা জনাকয়েক ওই ব্যাচের বন্ধু রয়েছি। কখনও সখনও দেখা করি নিজেরা। এমন আড্ডায় পুরনো বন্ধুদের কথা ফিরে ফিরে আসত।’’

ওই ব্যাচের আর এক কর্মী মানবেন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘‘তখন আমাদের মনে হল, তাইতো এখন সবাই কে কেমন আছে? আমাদেরই কেউ কেউ বলল, সবাই যদি ফের দেখা করা যায়। সেই ভাবনা থেকেই এমন পরিকল্পনা।’’ চাকরি শেষে জবলপুরে থিতু হওয়া অশোক গোস্বামী বলেন, ‘‘ভাগ্যিস ওরা এটা ভেবেছিল। তা না হলে জীবনের আর এক পিঠ অদেখাই থেকে যেত।’’

শোভন জানান, ভাবনাটা যত সহজ ছিল, আয়োজনটা মোটেই তেমন হয়নি। ১৯৭২ সালে তাঁরা ব্যাচে মোট ছিলেন ১৩০ জন। থাকতেন হস্টেলে। কয়েকজন স্থানীয় হলেও বাকিরা ছিলেন দূরদূরান্তের। তখন প্রশিক্ষণ শেষে পাকা চাকরির নিশ্চয়তা ছিল না। সেই জন্য এই দুই সংস্থার অস্থায়ী চাকরি ছেড়ে অন্য সংস্থায় যোগ দেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় শুরুতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাকিরা বদলি হয়ে কেউ জবলপুর, কেউ অমরনাথে চলে যান।

শোভন জানান, পুরনোদের একটা তালিকা প্রথমে বানানো হয়। কে কোথায় চাকরি করেছিলেন সেই মতো তাঁদের সংস্থায় যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে ফোন নম্বর মেলে। যোগাযোগ করা হয় তাঁদের সঙ্গে। সেটাও খুব সুখকর হয়নি। কারণ তালিকার ২২ জন ততদিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। যোগযোগের পরে তৈরি করা হয় একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ। সেখানেই ঠিক হয়, তাঁদের পুরনো জায়গায় ফের সকলে দেখা করবেন। তারই ফল শুক্রবারের পিকনিক।

মানবেন্দ্রনাথের স্ত্রীর কেমো চলছে। প্রণয় সরকার গুরুতর অসুস্থ। কেউ স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে কার্যত একলা। এ দিন পুরনো বন্ধুদের কাছে পেয়ে সকলেই বিহ্বল হয়ে পড়লেন। কেউ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। কেউ বিপত্নীক। প্রাথমিক আড্ডাতে জড়তা কাটতে সময় লাগলো না। এক তোড়ে মুছে গেল মাঝের ৪০-৪২টা বছর। প্রশিক্ষণের সময় খেতে বসে কে কতগুলো রুটি খেতেন, কে রাতের অন্ধকারে ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতেন, কে ভুতের ভয় পেতেন, তা আরও একবার উঠল।

কেউ বললেন, ‘‘এই জায়গাতে তো অফিসারস কোর্য়ার্টার্স ছিল। কত বদলে গিয়েছে। তবে গঙ্গার ধারটা কিন্তু একরকম রয়ে গিয়েছে।’’ আলোচনার মাঝে মৃত বন্ধুদের কথা উঠতেই পরিবেশ কিছুটা থমথমে হয়ে পড়ল। তবে তা কাটতে সময়ে লাগল না। পানাহারের আলোচনার পরে সকলেই নেমে পড়লেন নাচতে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। গঙ্গাপারে আক্লান্ত নেচে চলেছে বৃদ্ধের দল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন