বহু কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েই চলে ব্যবসা

টাকা মাটি, মাটি টাকা। সেই কবে বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কেউ মর্মার্থ বুঝে বিবাগী হয়েছে। কেউ আবার নিজের মতো ব্যাখ্যা করে হয়েছে ঘোরতর হিসেবি। চাহিদা বুঝে চলছে ব্যবসাও। আর যাকে কেন্দ্র করে অতিষ্ঠ দেগঙ্গা-শাসন এলাকার মানুষ। মাটি মাফিয়াদের দাদাগিরি আর ডাম্পারের দাপাদাপিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত তাঁদের। মাটি-বোঝাই গাড়ির ধাক্কায় একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে নানা সময়ে। বেআইনি এই ব্যবসার পরিস্থিতি কী, খতিয়ে দেখল আনন্দবাজার। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর) বিজিত ধরের কথায়, “আইন হল, কৃষি জমির মাটি কাটা যাবে না। অন্যত্র মাটি কাটতে গেলে কতটা মাটি কাটা হবে, তার তথ্য জানিয়ে সরকারকে রাজস্ব দিয়ে মাটি কাটার অনুমতি নিতে হয়।”

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৭
Share:

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মাটি বোঝাই লরি। নিজস্ব চিত্র।

কী ভাবে বেআইনি কারবার চালায় মাটি মাফিয়ারা?

Advertisement

উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর) বিজিত ধরের কথায়, “আইন হল, কৃষি জমির মাটি কাটা যাবে না। অন্যত্র মাটি কাটতে গেলে কতটা মাটি কাটা হবে, তার তথ্য জানিয়ে সরকারকে রাজস্ব দিয়ে মাটি কাটার অনুমতি নিতে হয়।” তিনি আরও জানান, ‘‘ইটভাটা বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে মাটি কাটার দরকার হলে স্থানীয় ভূমি ও ভূমিরাজস্ব অফিস থেকে ‘জি’ ফর্ম ভরাট করতে হয়।’’

এই সব নিয়মের থোড়াই কেয়ার করে মাটি ব্যবসায়ীরা। না তো রাজস্ব জমা পড়ে সরকারের ঘরে। না তো চাষের জমির পরোয়া করা হয়। তবে ভেরি অধ্যুষিত এলাকা শাসনে মাটি কাটার কিছু সুবিধা আছে। কারণ, ফি বছর মাটি তুলে ভেড়ি ড্রেজিং করাতে হয়। সেই সুযোগটাও নেয় মাটি কারবারিরা। শাসনে কী ভাবে অবাধে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মাটি কাটা চলছে, তা কি জানে না প্রশাসন? বিজিতবাবু জানান, বিষয়টি খোঁজখবর করে দেখা হবে।

Advertisement

কিন্তু এ সব যে নেহাতই কথার কথা, তা বিলক্ষণ জানেন দেগঙ্গা-শাসনের মানুষ। ডান-বাম কোনও আমলেই অবস্থাটা বদলায়নি। যদিও দু’পক্ষই দু’পক্ষকে দোষারোপ করতে ছাড়ে না। আর ও দিকে, ডাম্পারের ধাক্কায় ঘটে চলে একের পর এক দুর্ঘটনা।

কিছু দিন আগেই ডাম্পারের তলায় চাপা পড়ে শাসন থানার কাছে আগে মারা যান বাদুড়িয়ার বাসিন্দা উত্তম বিশ্বাস নামে এক যুবক। অবাধে মাটি কাটা ও নির্বিকার ভাবে চলা ডাম্পারের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদে নামেন এলাকার মানুষ। তারপরে থেকে অবশ্য বন্ধ ছিল মাটি কাটার কাজ, ডাম্পারের যাতায়াতও কমেছিল। কিন্তু ফের অবস্থা যে কে সেই। শুধু উত্তমের ঘটনা নয়, মাটি বহনকারী ডাম্পারের ধাক্কায় মৃত্যু বা প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই সব এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, কোনও একটা ঘটনার পরে কিছু দিন চুপ থাকার পরে ফের শুরু হয়ে যায় মাটি মাফিয়াদের দাপাদাপি। রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে পুলিশের চোখের সামনেই চলে কারবার।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদার এটুকু বলেই দায় সেরেছেন, ‘‘ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর অভিযোগ করলে সে ক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নিই। আর ডাম্পারে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’’ কিন্তু বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করতে কেন নিয়মিত পদক্ষেপ করা হয় না? কেনই বা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অভিযোগের অপেক্ষা করতে হয় পুলিশকে? এ সবের সদুত্তর নেই পুলিশ কর্তাদের কাছেও।

বারাসত ২ ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে শাসন, ফলতি-বেলিয়াঘাটা, দাদপুর, কীর্তিপুর ১ ও ২ পঞ্চায়েতেই বেআইনি ভাবে মাটি কাটার কাজ চলে বলে অভিযোগ। শুধু ভেড়িই নয়, কৃষিজমির মাটিও কাটা হয়।

সিপিএমের বারাসত ২ জোনাল কমিটির নেতা কুতুবউদ্দিন আহমেদের অভিযোগ, “কোটি-কোটি টাকার মাটি কাটার কাজ করছে মা-মাটি-মানুষের দলের নেতারাই। মাটি কাটার বিরুদ্ধে যা কিছু আন্দোলন হয়েছে, তা করেছি আমরাই।” কুতুবউদ্দিনের আরও অভিযোগ, “শাসকদলের একাংশ এই সব বেআইনি কারবারের বখরা পেয়ে থাকে।”

বারাসত ২ ব্লকের তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার সাঁপুই আবার বললেন অন্য কথা। মাটি কাটার সঙ্গে তৃণমূলের জড়িত নয় বলেই তাঁর দাবি। মতিয়ারের আবার যুক্তি, ‘‘আসলে পলি পড়ে পড়ে কিছু জলকর, ভেড়ির জমি এতটাই উঁচু ডাঙা হয়ে গিয়েছে যে সেখানে মাছ চাষ করা যাচ্ছে না। সেই ভেড়িও কেউ লিজে নিতে চাইছে না। বাধ্য হয়েই সেই মাটি কেটে ফেলতে হচ্ছে। এর সঙ্গে মাটি মাফিয়া বা অন্য কারও কোনও ব্যাপার নেই।’’

চাপানউতোর আছে। যুক্তির পর যুক্তি সাজানোর খেলা আছে। কিন্তু দেগঙ্গা-শাসনের মানুষের অভিজ্ঞতা হল, মাটির গাড়ির দাপাদাপি বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই। বরং ফি বছর ডাম্পারের ধাক্কায় কারও না কারও মৃত্যু যেন ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন