কড়া নজর, তবু বিয়ে বহু নাবালিকারই
Death

অবশেষে মারা গেল অগ্নিদগ্ধ কিশোরী-প্রসূতি

মঙ্গলবার রাতে বারাসত জেলা হাসপাতালে মারা যায় অশোকনগর থানার গুমা সুকান্তপল্লি এলাকার বাসিন্দা পূজা।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২০ ০২:৩৩
Share:

পূজা মণ্ডল।

পনেরো বছর বয়সে বাড়ির অমতে ঘর বেঁধেছিল ভালবাসার মানুষের সঙ্গে। সে সুখ সইল না বেশি দিন। সতেরো বছরেই মারা গেল পূজা শীল। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল মেয়েটি। তার হাত-পা বেঁধে শ্বশুরবাড়ির লোকজন পুড়িয়ে মেরেছে বলে অভিযোগ। গ্রেফতার হয়েছে স্বামী বিপুল শীল, শ্বশুর বিমল শীল ও শাশুড়ি নন্দিতা।

Advertisement

মঙ্গলবার রাতে বারাসত জেলা হাসপাতালে মারা যায় অশোকনগর থানার গুমা সুকান্তপল্লি এলাকার বাসিন্দা পূজা। তার মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়িয়ে কী করে পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হল তার। বহু তরুণীর অপমৃত্যুতে সম্প্রতি সামনে এসেছে যে তথ্য, তাতে দেখা যাচ্ছে, অনেকেরই বিয়ে হয়েছিল অপরিণত বয়সে। বিয়ের পরে কখনও পণের দাবিতে, কখনও অন্য কারণে শ্বশুরবাড়িতে শুরু হয় অত্যাচার। শেষমেশ মৃত্যুও হয় অনেকের। অন্য ভাবেও কোনও বিপদ-আপদ ঘটলে তখন জানাজানি হয়, বিয়ে হয়েছিল আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগেই। ভালবেসে বিপুলকে বিয়ে করলেও অভিযোগ, পূজাকেও পণের দাবিতে অত্যাচার করা হত শ্বশুরবাড়িতে।

পূজার বাবা রবীন্দ্রনাথ বাড়ৈ জানিয়েছেন, আঠারো বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওা যে বেআইনি, তা তিনি জানতেন। তা হলে পুলিশ-প্রশাসনকে কেন জানালেন না সে সময়ে? সদ্য কন্যাহারা বাবার যুক্তি, ‘‘পুলিশের কাছে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তখন ছিল না। আর আমরা গরিব মানুষ। পুলিশি ঝঞ্ঝাটে জড়াতে চাইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে সময়ে পুলিশের কাছে গেলে হয় তো এ ভাবে মেয়েকে মরতে হত না।’’

Advertisement

পূজা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। সে গুমা নজরুল বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ত। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মঞ্জুষা ভৌমিক বলেন, ‘‘কেউ হঠাৎ করে স্কুলে আসা বন্ধ করলে বোঝা সম্ভব নয়। তবে পরীক্ষার সময় আমরা লক্ষ্য রাখি, কারা পরীক্ষা দিল না। সেই মতো খোঁজ খবর করা হয়। আগেভাগে জানতে পারলে বিয়ে বন্ধ করার উদ্যোগ নিই।’’

গত বছর হাবড়ার বাসিন্দা উনিশ বছরের এক তরুণী জ্বর-ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছেন। সায়নী হালদার নামে ওই তরুণীর দেড় বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। তাঁরও নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়েছিল। গত বছরই হাবড়ায় কোলের শিশুপুত্রকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন এক তরুণী। ওই তরুণী মারা গেলেও শিশুটি বেঁচে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও জানা গিয়েছে, তরুণীর নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়েছিল।

নাবালিকা বিয়ে আটকাতে পুলিশ-প্রশাসন এখন অনেক বেশি সক্রিয়। বহু কিশোরীর বিয়ে আটকানোও হচ্ছে। এ কাজে সাহায্য করছে চাইল্ড লাইন। স্কুলে স্কুলে সেমিনার করে মেয়েদের সচেতন করা হচ্ছে। চালু হয়েছে কন্যাশ্রী ক্লাব। তা-ও বহু ঘটনায় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে নাবালিকা বিয়ে যে হচ্ছে, পূজা-সুস্মিতাদের মৃত্যুর ঘটনা সে দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

কেন ঘটছে এমন ঘটনা?

পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, অল্পবয়সী মেয়েরা আবেগের বশে বা প্রলোভনে পা দিয়ে ফেলছে। বিশেষ করে, স্কুলে যাওয়ার পথে অচেনা কোনও ছেলের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে। ফোনে মিসড কল থেকেও সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে অচেনা যুবকের সঙ্গে পরিচয় ঘটছে। এর ফলে নাবালিকা বিয়ে যেমন হচ্ছে, তেমনই নারীপাচারের মতো ঘটনাও ঘটছে বলে নজরে এসেছে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের। প্রশাসনের দাবি, শুধু প্রশাসন ও পুলিশের তৎপরতা দিয়ে কাজ হবে না। মানুষের সচেতনতা না বাড়লে এই প্রবণতা পুরোপুরি
আটকানো মুশকিল।

পুলিশ কর্তাদের মতে, অল্পবয়সী মেয়েদের হাতে মোবাইল দিতে হলেও তারা মোবাইল কী ভাবে ব্যবহার করছে, তার দিকে যেন অভিভাবকেরা নজর রাখেন। স্কুলে যাতায়াতের পথেও যেন নজর থাকে বাড়ির লোকের। প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পর কিশোরীদের জায়গা হয় হোমে বা বাড়িতে। উদ্ধার হওয়া অনেক নাবালিকা আবার বাড়িতে ফিরতে চায় না। তাদেরও হোমে পাঠানো হয়। কিন্তু সব মিলিয়ে ব্যাহত হয় লেখাপড়া।

হাবড়ার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বলেন, ‘‘আমরা স্কুলে এ নিয়ে ছাত্রীদের সচেতন করি। স্কুলে মোবাইল নিয়ে আসাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্কুলের বাইরে আসা-যাওয়ার পথে মেয়েদের উপরে নজর রাখা আমাদের সম্ভব হয় না।’’

জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘স্কুলে কন্যাশ্রী ক্লাব তৈরি করা হয়েছে। তাদের মাধ্যমে এলাকাতেও নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করা হচ্ছে। চাইল্ড লাইন ও প্রশাসনের তরফেও নজরদারি রাখা হয়ে থাকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন