বরুণ বিশ্বাসের স্মরণসভায় কমছে ভিড়

প্রতিবাদীকে কি ভুলছে সুটিয়াবাসী

গত বছরও কার্যত একই চিত্র ছিল এই দিনটায়। তার আগের বছরগুলিতে অবশ্য এলাকায় পোস্টার সাঁটিয়ে, মাইকে প্রচার চালিয়ে বিশাল স্মরণ সভার আয়োজন হত সুটিয়ায়। শহর কলকাতা বা রাজ্যের অন্য প্রান্ত থেকেও অনেকে আসতেন। বরুণের মৃত্যুতে যাঁরা স্মরণসভায় এসে বলেছিলেন, ‘‘প্রতিবাদীর মৃত্যু হয়, প্রতিবাদের হয় না’’ সেই ধ্বনি কি তবে স্তিমিত হয়ে এল?

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

গাইঘাটা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৭ ২২:০০
Share:

ভাইকে-শ্রদ্ধা: সুটিয়ায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

আকাশ ভাঙা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সে দিন বরুণের দেহ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। বলেছিলেন, বরুণের খুনিরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন আন্দোলন। কিন্তু ২০১২ সালের ৫ জুলাই সেই দিনটার পরে পাঁচ বছরের মাথায় দেখা গেল, গাইঘাটার সুটিয়ায় বরুণ বিশ্বাসের বাড়ির কাছে তাঁর আবক্ষ মূর্তিতে মালা দিয়ে আর হাতে গোনা কয়েকজন মানুষজনের উপস্থিতিতে নমো নমো করে অনুষ্ঠান সারল সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চ। অনুষ্ঠানে এলেনই না মঞ্চের সম্পাদক। বরুণের বাড়িতে গিয়ে তাঁর ছবিতে ফুল-মালা দেন কিছু অনুরাগী, ছাত্রছাত্রী।

Advertisement

কিন্তু ওই পর্যন্তই।

গত বছরও কার্যত একই চিত্র ছিল এই দিনটায়। তার আগের বছরগুলিতে অবশ্য এলাকায় পোস্টার সাঁটিয়ে, মাইকে প্রচার চালিয়ে বিশাল স্মরণ সভার আয়োজন হত সুটিয়ায়। শহর কলকাতা বা রাজ্যের অন্য প্রান্ত থেকেও অনেকে আসতেন। বরুণের মৃত্যুতে যাঁরা স্মরণসভায় এসে বলেছিলেন, ‘‘প্রতিবাদীর মৃত্যু হয়, প্রতিবাদের হয় না’’ সেই ধ্বনি কি তবে স্তিমিত হয়ে এল?

Advertisement

উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখে গেল, ভিতরে ভিতরে বরুণ বিশ্বাসকে নিয়ে আবেগ এখনও উজ্জ্বল। কিন্তু সামনে এসে সে সব কথা বলায় কোথায় যেন কুণ্ঠা সুটিয়ার মানুষের।

২০০০-২০০২ সালে সুটিয়ায় একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদী মঞ্চ গড়়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন বরুণ ও তাঁর মতো আরও বহু মানুষ। ধরাও পড়ে বেশ কয়েকজন। সাজা হয়। গণধর্ষণের আরও কিছু মামলা তখনও চলছিল। যার মূল সাক্ষী ছিলেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের (মেন) বাংলার শিক্ষক বরুণ। এলাকায় প্রতিবাদী মুখ হিসাবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঘরে। উপকারী, মিষ্টভাষী যুবকটিকে ভালবাসতেন অসংখ্য মানুষ।

২০১২ সালের ৫ জুলাই এই বরুণকেই গোবরডাঙা স্টেশনের বাইরে গুলি করে মারে কিছু দুষ্কৃতী। তাঁর খুনের পরে এককাট্টা হন এলাকার অসংখ্যা মানুষ। বরুণের খুনিদের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় গোটা রাজ্য।

সিবিআই তদন্তের দাবি থাকলে সিআইডি তদন্তভার গ্রহণ করে। তারা জানায়, দমদম সেন্ট্রাল জেলে বসে বরুণকে খুনের ছক কষেছিল সুশান্ত চৌধুরী। এই ব্যক্তি আবার সুটিয়া গণধর্ষণ-কাণ্ডের অন্যতম সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সেই মামলা এখনও চলছে। ১০ জন অভিযুক্তের মধ্যে ধরা পড়েছে ৮ জন। সুশান্ত পরে আলিপুর জেলে মারা যায়। বনগাঁ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব এখনও শেষ হয়নি।

কিন্তু খুনিদের শাস্তির দাবি কি তবে থমকে গেল? কেন?

স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের সঙ্গে নানা কারণে বরুণের পরিবারের দূরত্ব বাড়া এর অন্যতম কারণ। বরুণের দিদি প্রমিলা রায় মঞ্চের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি-সহ নানা অভিযোগ তোলে। মঞ্চের বক্তব্য, সে কারণে তারাও ইদানীং মিটিং-মিছিল কমিয়ে দিয়েছে।

প্রমিলাদেবী আবার অভিযোগ তোলেন, শাসকদলের নেতা তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়বাবুর ইন্ধন ছিল বরুণের খুনে। এই ঘটনায় বিধাননগর আদালতে মানহানির মামলা করেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু। সেটিও বিচারাধীন। এ দিকে, সুটিয়া, গাইঘাটা, বনগাঁ-সহ আশেপাশের গোটা এলাকায় শাসক দলের প্রভাব প্রশ্নাতীত। বরুণের পরিবার তৃণমূল নেতার নাম জড়ানোয় অনেকে বরুণকে নিয়ে আন্দোলনের পাশ থেকে সরে যান বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের মত।

প্রমিলা বলেন, ‘‘আমার ভাইকে কেউ ভোলেনি। কিন্তু শাসক দলের লোকজন মানুষকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে।’’ এ কথা মানতে নারাজ গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ধ্যানেশনারায়ণ গুহ। তাঁর চ্যালেঞ্জ, ‘‘কাউকে ভয় দেখানো হয়েছে, এমন একটা উদাহরণ সামনে এনে দেখান ওঁরা।’’

ছেলের মৃত্যুর পরে এলাকা ছেড়ে চলে যান বাবা জগদীশ বিশ্বাস, মা গীতাদেবীরা। এখন সুটিয়ার বাড়িতে থাকেন প্রমিলাদেবীই। তাঁর এখনও দাবি, ভাইয়ের খুনের ঘটনায় শেষ দেখে ছাড়বেন তিনি।

এত সবের মধ্যেও আশার কথা শুনিয়েছেন প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দার। তিনি জানান, ‘‘খুনিদের শাস্তি চেয়ে নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করা হবে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement